রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেড়েছে খুন, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। প্রতিদিনই বেপরোয়াভাবে চলছে ছিনতাই। আজ যাত্রাবাড়ি তো কাল বণশ্রী, আবার পরশুদিন ধানমন্ডি, তার পর হয় মোহাম্মদপুর কিংবা শ্যামলী। এভাবে রাজধানীজুড়েই একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছেই। যা সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন কারণে, ছিনতাইকারীরা এখন আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে, এবং অপরাধের ধরনও দিন দিন আরও নৃশংস হয়ে উঠছে। এতে রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গত রোববার রাতে রাজধানীর বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনা একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, রাতের বেলা একটি বাসার সামনে এক ব্যক্তির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন একজন। তাঁদের একজন নিচে, অপরজন ওপরে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন দুই ব্যক্তি। দুজনেরই মাথায় হেলমেট। একজনের মাথায় কালো রঙের হেলমেট, অপরজনের লাল রঙের হেলমেট। তিনটি মোটরসাইকেল কাছে এসে দাঁড়ায়। তখন তিনটি মোটরসাইকেলে মোট চারজন আরোহী ছিলেন। একটিতে চালকসহ দুজন আরোহী ছিলেন। দুটি মোটরসাইকেল কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। অপরটি একটু সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ধস্তাধস্তিতে নিচে পড়া ব্যক্তির হাত থেকে ব্যাগের মতো দেখতে কিছু একটা ছিনিয়ে নেন কালো হেলমেট পড়া ব্যক্তি। একজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তির মধ্যে ‘ভুক্তভোগী’ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে কিছুটা দূর থেকে গুলি করেন লাল হেলমেট পরা ব্যক্তি। তখনো একজনের সঙ্গে ভুক্তভোগীর ধস্তাধস্তি চলছি। গুলির পর ভুক্তভোগী ব্যক্তি তাঁর হাত ছাড়িয়ে পেছনের দিকে দ্রুত সরতে থাকেন। ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া ব্যক্তি কিছুটা দৌড়ে গিয়ে একদম সামনে থাকা মোটরসাইকেলটির পেছনে চেপে বসেন। লাল হেলমেটধারীসহ অন্য দুজন আরেকটি মোটরসাইকেলের পেছনে বসেন। পরে মোটরসাইকেল তিনটি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ছিনতাইকারীরা তাঁর কাছ থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়েছে।
দেশে ফিরেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ ডালিম। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে প্রাইভেট কারযোগে গ্রামের নরসিংদী যাবার পথে পূর্বাচল ৩০০ ফিট জলসিড়ি অটোস্ট্যান্ডে তিনি হামলার শিকার হন। বিমান বন্দর থেকে ডালিমকে অনুসরণ করতে থাকা ঢাকা-মেট্রো-চ-২০-৩৪২৯ যোগে মাইক্রোবাস আরোহী ৩-৪ জন ছিনতাইকারী ডালিমের প্রাইভেট কারের গতিরোধ করে। এরপর অস্ত্রের মুখে নগদ অর্থ, দামি মোবাইল, স্বর্ণালঙ্কারসহ ১৭ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। গত ১৪ জানুয়ারি রাত আড়াইটায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রতিদিনের মতো জীবিকার তাগিদে একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকার আব্দুর রহমান। দিন পেরিয়ে গভীর রাতেও বাসায় ফেরেননি তিনি। পরে জানা যায়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা আব্দুর রহমানকে খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত চেতনানাশক দেয়ায় মারা যান তিনি। অটোরিকশা ছিনতাই করে তাকে ফেলে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর থেকে যাত্রী পরিচয়ে তার অটোতে উঠেন তিনজন। পথের মাঝে ওই যাত্রীরা কৌশলে আব্দুল হামিদকে জুস পান করান, যার মধ্যে মেশান ছিল নেশাজাতীয় দ্রব্য। জ্ঞান হারালে তাকে সড়কের পাশের ফুটপাতে ফেলে রেখে অটোরিকশা নিয়ে তারা পালিয়ে যান। দুদিন পর মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা যান অটোচালক হামিদ।
মাস দুয়েক আগে বিকালে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন টিনশেড বাড়ির ওপর এক কিশোরকে চার-পাঁচ জনের কিশোর গ্রুপ চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্যে কোপাতে দেখা যায়। মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের ফুটপাতে গভীর রাতে এক পথচারীর কাছ থেকে ছিনতাই করার সময় চাপাতি বাহিনীর চকচকে চাপাতি প্রদর্শনের দৃশ্যও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। গত মাসে যাত্রাবাড়ীতে রিকশায় এক দম্পতির কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় চাপাতি বাহিনী। এ সময় চাপাতির আঘাতে স্বামী গুরুতর আহত হন।
চলতি বছরের শুরুতে গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে গ্যাং গ্রুপের কয়েকশ সদস্য। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন। ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়।
গত ২১ জানুয়ারি গুলশান-২ নম্বরে রাত নয়টার দিকে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মালিক আবদুল কাদের ও তার শ্যালক আমির হামজা গুলশান-১ হয়ে মোটরসাইকেলে বাসায় যাচ্ছিলেন। পথে ডিএনসিসি মার্কেটের সামনে ১৫-২০ জন তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করেন। পরে রড, ইট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে নগদ প্রায় এক কোটি টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমির হামজা ও কাদের আহত হন।
লালমনিরহাটে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় পাঁচ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে লালমনিরহাট সদর থানা পুলিশ। ওসি তদন্ত বাদল কুমার মন্ডর জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রবিবার ভোরে তার নেতৃত্বে লালমনিরহাটে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে জেলা শহরের মিশনমোড় এলাকার সীমান্ত আবাসিক হোটেলে থেকে ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এ সময় আটককৃতদের কাছে থেকে ধারালো চাপাতি, ৫টি সুতার মোটা রশি, কাঠের হাতল যুক্ত একটি চেইন, একটি চাকু, বড় কসটেপসহ ডাকাতিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে দেশব্যাপী ২১৮টি টহল দল মোতায়েন এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল মঙ্গলবার র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদে গত রোববার ও সোমবার সমাবেশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেয় একদল শিক্ষার্থী। তাঁদের ভাষ্য, দেশব্যাপী ছিনতাই, হামলা, ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে গেছে। দেশের মানুষকে সুরক্ষা দিতে না পারলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের আহ্বান জানান তাঁরা। শিক্ষার্থীরা বলেন, গত সরকারের আমলে ধর্ষণসহ নানা অপরাধের বিষয়ে কোনো বিচার হয়নি। সে জন্য অপরাধীরা সাহস পেয়ে গেছে। এসব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে শক্ত হাতে অপরাধীদের দমন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাঁরা দাবি জানান।
ছিনতাইরোধে পুলিশের তিনটি বিশেষায়িত ইউনিট মাঠে কাঝ করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেন, অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে, বিশেষ করে রাতকালীন ছিনতাই। ছিনতাই হচ্ছে বিষয়টি আমরা নোটিশে নিয়েছি। আমরা এটা ধারণা করে গত শনিবার সকালে বিশেষ একটি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, এন্টি ট্যুরিজম ইউনিট ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- তিন অর্গানাইজেশন মিলে ইনটেনসিভ পেট্রোলিং করবে।
দেশের চলমান অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ ও এর ‘দোসরদের’ দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবে হোক এটা প্রতিহত করা হবে। টহল কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পাবে। আমরা যেভাবেই হোক আইনশৃঙ্খলা পরুস্থতি উন্নয়ন করব। সন্ত্রাসীরা যাতে ঘুমাতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেনো গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, ডেভিল হান্ট-এর মাধ্যমে আমাদের কাজ চলবে। সন্ত্রাসীরা কোথাও কোনো জায়গায় যেন ঘুমাতে না পারে, বসতে না পারে, দাঁড়াতে না পারে—সেই ব্যবস্থা আমরা করব।
উপদেষ্টা সম্পাদকঃ আব্দুল লতিফ
প্রধান সম্পাদকঃ এম এস এন মাসুক হিমেল
সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ হাউজ ২৪, রোড ৩, মনিপুরি পাড়া, ফার্মগেট ঢাকা।
আঞ্চলিক কার্যালয়ঃ ৭ মতি কমপ্লেক্স রোড চকবাজার চট্টগ্রাম
মোবাইলঃ ০১৯৯৪৪২২৭৮৯
ই-মেইলঃ news@dainikprovhatersangbad.com