শেখ হাসিনার সরকার পতনের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ব্যবসাবাণিজ্যে স্বস্তি ফেরেনি। ব্যবসার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সরকারের সেবাদানকারী সংস্থাগুলোতেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। এমন পরিস্থিতির কারণে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সার্বিকভাবে আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন অনেক ব্যবসায়ী। ব্যাংকিং খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এখনো উপেক্ষিত। ফলে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি।
অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত স্থবির হওয়ায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও স্বাভাবিক গতি ফেরেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যদিও বলা হচ্ছে, জুলাই-আগস্টে উৎপাদন খাতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কাটিয়ে পণ্য রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। টানা ৭ মাসে ২ হাজার ৮৯৬ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ঋণখেলাপি, কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকের অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে। লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছেন। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ডলারের দর ১২২ টাকার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বেসরকারি বিনিয়োগ আটকে আছে ২৩ থেকে ২৪ শতাংশের মধ্যে।
জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে কিংবা সরকারের তহবিলে বেশির ভাগ রাজস্ব দিয়েও কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, কখনো ভুলনীতি, কখনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় ব্যবসায়ীদের শিল্প-ব্যবসা-বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধ, প্রাকৃতিক কিংবা মানুষের তৈরি দুর্যোগও তাঁদের শিল্প বা উদ্যোগের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে নিরাপত্তাহীনতা, মামলা-হামলা, উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি সংকট, অতিমাত্রায় ইউটিলিটির খরচসহ নানান সংকটে তাঁদের ব্যবসা-শিল্প এখন নাজুক পরিস্থিতি পার করছে।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২-২৩ সালের একটি জরিপের তথ্যে বলা হয়েছে, দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২৩.১০ শতাংশ। এর মধ্যে বড় শিল্পের অবদানই ১১.২০ শতাংশ। বড় শিল্পে ভর করে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকারও বড় হচ্ছে। বিবিএসের ২০২২ সালের আরেকটি জরিপের তথ্য বলছে, দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার আকার পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৮৬ লাখ মানুষ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় জড়িত। ২০২৩ সালে বিবিএসের আরেকটি জরিপ বলছে, দেশের সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। এর মাত্র ৫ শতাংশেরও কম সরকারি চাকরিতে। ফলে বেশির ভাগই বেসরকারি কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। সরাসরি ব্যক্তি খাতেই কাজ করছেন ৪৭.৯ শতাংশ মানুষ। সুতরাং তথ্য-উপাত্ত বলছে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই বেসরকারি খাত। যার নেতৃত্ব দেন দেশের শিল্পোেদ্যাক্তারা। অথচ তাঁরাই এখন নানান সংকটের মুখে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ কালের বলেন, শিল্পপতিদের আস্থায় নিতে হবে। বিশেষ করে তাঁদের কারখানায় কোনো ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে অ্যাক্টিভ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রাইওরিটি দিতে হবে। সত্যিকারের যাঁরা উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী, যাঁরা সমস্যায় পড়ে গেছেন, যাঁদের ব্যাংক ব্যাকআপ করতে রাজি আছে, সব নিয়মনীতি মেনে যদি মনে করা হয়, কিছু টাকা পেলে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভাবছি তাদের কিভাবে সহায়তা করা যায়। আমি সরকারের তিনটি কমিটিতে কাজ করছি। কিভাবে ৫০ কোটি টাকার ওপরে ঋণগুলোকে রিভিউ করা যায়, এ ব্যাপারে আমরা অলমোস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, যদি আমাদের মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের কথা বলি সব ক্ষেত্রেই একই অবস্থা রয়ে গেছে। কাজেই সবকিছু মিলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে একটা স্থবিরতা বিদ্যমান। কোথাও চলমান হওয়ার সম্ভাবনাটা চোখে পড়ছে না। তিনি আরও বলেন, ৬ মাসের বেশি হয়ে গেলেও সমস্যাগুলো এখনো জিইয়ে আছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো এখনো ওই ভাবেই চলছে। ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের একটা বড় বিষয় ছিল। সেই বাজার ব্যবস্থাপনার কী উন্নয়ন হয়েছে, আগের মতোই রয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ৭ মাসেও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রত্যাশিত পরিবেশ ফিরেনি। তবে আমরা এখনো আশবাদী সরকার দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগের চিন্তাই করছি না। ব্যবসা পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নানা জায়গায় নীতি সহায়তা দরকার।
উপদেষ্টা সম্পাদকঃ আব্দুল লতিফ
প্রধান সম্পাদকঃ এম এস এন মাসুক হিমেল
সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ হাউজ ২৪, রোড ৩, মনিপুরি পাড়া, ফার্মগেট ঢাকা।
আঞ্চলিক কার্যালয়ঃ ৭ মতি কমপ্লেক্স রোড চকবাজার চট্টগ্রাম
মোবাইলঃ ০১৯৯৪৪২২৭৮৯
ই-মেইলঃ news@dainikprovhatersangbad.com