সরকারী মুরগির খামারের বরাদ্দ গিলে খেল প্রানীসম্পদ কর্মকর্তা

Reporter Name / ২১ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

 

সাইনবোর্ড সর্বস্ব সরকারি মুরগির খামারে দেড়মাস বয়সী ২০০ মুরগীর বাচ্চা ঘোরাঘুরি করছে একটি শেডের ভেতর। পাঁচটি শেডের বাকি চারটি জরাজীর্ণ অবস্থায় খালি পড়ে আছে। আর ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদনের হ্যাচারি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বহুদিন থেকে। এইভাবেই চলছে নোয়াখালীর সরকারি মুরগির খামারটি। প্রতি অর্থ বছরে সংস্কার ও মুরগির খাদ্যের জন্য বরাদ্দের লাখ লাখ টাকার হিসেব কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে হদিস নেই।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নোয়াখালীর সরকারী মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারে ২০২৪-২০২৫ চলতি অর্থ বছরে দুই ধাপে মুরগি খাবারের জন্য মোট ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ মোহাম্মদ রেয়াজুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে মৎস ও প্রাণী খাদ্য বাবদ নোয়াখালী সরকারী মুরগী প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের ব্যবস্থাপক বরাবর ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত আরেক চিঠিতে মৎস ও প্রাণী খাদ্যের জন্য নোয়াখালী সরকারী মুরগী প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের ব্যবস্থাপক বরাবর ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে মোট ৩০ লাক্ষ টাকা খাদ্য বাবদ বরাদ্দ পায় নোয়াখালী সরকারী মুরগী প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। তবে তথ্য বলছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে মুরগীর পালন বন্ধ রয়েছে। যেকারনে প্রশ্ন উঠছে মুরগীর খাবারের জন্য বরাদ্দের ৩০ লাখ টাকা তাহলে গেলো কোথায়?

এছাড়া গত সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যায় বাবদ ৪০ হাজার টাকা, আসবাবপত্র, কম্পিউটার ও আনুষাঙ্গিক সহ মোট ৯ লাখ ৫৮ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা বাদেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অফিস সংস্কারের জন্য নভেম্বরের ২১ তারিখ ভবন ও স্থাপনা খাতে ব্যবস্থাপক বরাবর ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

নোয়াখালীর সরকারী মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছরে তাদের ৩০ হাজার মুরগি পালনের টার্গের থাকে। এই খামারের হ্যাচারী ভবনের কার্যক্রম দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে। তাই চট্টগ্রাম থেকে সরকারি ভাবে এখানে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা পাঠানো হয়। দেড় মাস বয়সে বিক্রি করা হয় সেগুলি। আর মুরগীর খাবার সরবরাহের জন্য উন্মুক্ত  দর পদ্ধতিতে টেন্ডার আহবান করা হয়। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করে থাকে। চলতি অর্থ বছরে এই খামারে খাবার সরবরাহ করছে তাইম এন্টারপ্রাইজ।

জানা যায়, জনগণের করের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠান জন্মের পর থেকেই চলছে ভর্তুকি দিয়ে। জবাবদিহিতা ও এই খাত থেকে উপার্জনের লক্ষ মাত্রা না থাকায় সবকিছুই চলে দায়সারা ভাবে। এ যেন সরকারি মাল দরিয়ায় ঢাল অবস্থা। ডিম, মুরগি ও বাচ্চা উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে ভূমিকা রাখার নজির নেই প্রতিষ্ঠানটির। ব্যক্তিগত ভাবে লালন-পালনের জন্য দুই-দশটি মুরগি বাজারের চেয়ে কমদামে কিনতে পারেন স্থানীয়রা। এর বাইরে কোন সেবা দিতে পারছেনা সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। তবে কমদামে এখান থেকে মুরগি কিনতেও ভাগ্য লাগে। উৎপাদন কম থাকায় চাইলেই মুরগি পাওয়া যায় না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইট না থাকায় তথ্য মেলেনা সহসা। আর বিজ্ঞাপনের জন্য প্রতি বছরে অর্থ বরাদ্দ আসলেও কার্যক্রম ও সেবা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির কোন প্রচার-প্রচারনা নেই।

খামার পরিদর্শনের সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানান, মুরগির খাবার এখান থেকে বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে কোথায়, কখন, কিভাবে খাবার বাইরে বিক্রি হয় এমন প্রশ্ন করলে তিনি অফিসের চারপাশে সিসি ক্যামেরা রয়েছে, নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি প্রতিবেদকে এড়িয়ে যান।

সরেজমিনে দেখা যায়, জরাজীর্ণ অবস্থা পুরো খামারের। মুরগির বাচ্চা লালনের পাঁচটি সেডের অবস্থাও করুন। এর মধ্যে তিনটি সেডের বাইরের দেয়ালে নামে মাত্র রং করা হয়েছে। আর বাকি দুটি সেডের ভুতুড়ে অবস্থা। খামারের পূর্বপাশে শেওলা পড়া হ্যাচারি ভবনটি পরিত্যক্ত কক্ষের মত  তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। অফিসকক্ষের অবস্থা আরো করুন। অফিসের বাইরে কোনরকম রং করা হয়েছে। রঙের ওপর থেকেই দেওয়ালের খসেপড়া আস্তরের ক্ষত বোঝা যাচ্ছে। আর বন্যার পানিতে প্রতিটি টেবিল নষ্ট হয়ে সেগুলোর পারটেক্স বোর্ড ফুলে উঠেছে। কোথাও কোথাও টেবিলের নিচের অংশের বোর্ড খসে খসে পড়ছে।

গুদাম ঘরের বাইরের দেয়ালে রং করা হয়েছে। আর ভেতরে ছোটো-ছোটো কালো রংএর পোকায় ছয়লাব পুরো গুদাম। দুই দেয়ালের পাশ্বে স্তুপ করে রাখা আছে কিছু ভুট্টা ও চালের কুড়োর বস্তা। ছেড়া বস্তাগুলো থেকে ভুট্টা পড়ে মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া অল্প কিছু লবনের প্যাকেট, সয়াবিন মিল, প্রোটিন কনসালটেন্ড, লাইমস্টোনের বস্তা রয়েছে সেখানে। তবে গুদামে থাকা সব বস্তা মিলিয়ে সেখানে ৩০ লাখ টাকার খাবার রয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান খাদ্য গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী।

খামারের উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ আলা উদ্দিন জানান, বর্তমানে জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভবন তৈরীর কাজ চলছে এজন্য ওই অফিসের কর্মচারীরা মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারে রয়েছেন। যেকারণে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রোগবালাইয়ের কথা বিবেচনা করে গত বছরের ফেব্রুয়ারী থেকে সেডে মুরগি পালন বন্ধ রয়েছে। সীমিত আকারে একটি সেডে দেড় মাস বয়সী অল্পকিছু বাচ্চা রয়েছে। তবে মুরগি না থাকলে ৩০ লাখ টাকার খাবার কোথায় গেলো এমন প্রশ্ন করলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। এছাড়া বিজ্ঞাপন ব্যায়, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, আনুষাঙ্গিক ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অফিস সংস্কারের বরাদ্দের বিষয়ে প্রশ্ন করলেও মন্তব্য করেননি তিনি।

খাবার সরবরাহের বিষয়ে কথা হলে  ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তাইম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী আব্দুল বারেক জানান, গত তিন বছর থেকে তার প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করে আসছে। তবে চলতি অর্থ বছরে মোট কত টাকার মুরগির খাবার তিনি নোয়াখালী মুরগি খামারে পাঠিয়েছে সেই তথ্য প্রতিবেদকের কাছে বলেননি।

স্থাপনা সংস্কার ও খামারের মুরগির খাবারে জন্য বরাদ্দের টাকার বিষয়ে জানতে কথা হয় নোয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা  মোঃ আবুল কালাম আজাদের সাথে। তিনি জানান, সংস্কার কাজের বরাদ্দের টাকা দিয়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে, একটি সেডের ছাদ সংস্থার ও রংএর কাজ করা হয়েছে। এছাড়া মুরগির খাবারের জন্য যে টাকা এসেছে সেই টাকার খাবার কেনা হয়েছে। সব খাবার খামারের গুদামে রয়েছে বলে জানান তিনি।

এবিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক(উৎপাদন) ডাঃ এবিএম খালেকুজ্জামান জানান, নোয়াখালী জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভবন তৈরীর কাজ চলায় ওই অফিসের কর্মচারীরা নোয়াখালী  মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারে রয়েছেন। যে কারনে ওখানে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে দ্রুতই হ্যাচারি সহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করা হবে।

এছাড়া নোয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তার খামারের খাদ্য গুদামে ৩০ লাখ টাকার খাবার থাকার দাবির প্রেক্ষিতে গুদামের বাস্তব চিত্র তুলেধরা হলে খালেকুজ্জামান অধিদপ্তর থেকে টিম পাঠিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/