বিশেষ প্রতিনিধি
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ
(Google News) ফিডটি
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে ১৩ বছরেও পারেনি আইন শৃংখলা বাহিনীর একাধিক এজেন্সী। এই তের বছরে মামলার চার্জশিট দাখিলের জন্য ১১৭ বার তারিখ পেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি এই মামলার চার্জশিট বা অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করতে পারেনি এজেন্সীর কর্মকর্তারা। এ বছরের পর বছর কালক্ষেপণের কারনে গোটা সাংবাদিক মহলে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা।
এবিষয়ে উচ্চ আদালত সূত্র বলেছে, এই মামলার চার্জশিট দাখিলের জন্য আরো ছয় মাস সময় পেল বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স। তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন। এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তদন্ত শেষে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। আদালতের আদেশের পর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উৎঘাটন করা হবে। তারপর পেরিয়ে গেছে ১৩টি বছর। এর মধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পিছিয়েছে ১১৭ বার। একাধিকবার বদলেছে তদন্ত সংস্থাও। কিন্তু নির্মম সেই হত্যাকান্ডের রহস্য আজও উদঘাটন হয়নি।
প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। বর্তমানে মামলাটির তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। সর্বশেষ ১৫ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন সেই প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয় পিবিআই। আগামী ২১ মে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন দিন ঠিক করেছেন ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলাম।
বিষয়টি নিয়ে হতাশা জানিয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, আমরা খুবই আশাবাদী ছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের চার্জশিট দাখিল করা হবে। কিন্তু ছয় মাস তো অতিবাহিত হতে চলল। এরই মধ্যে ডিবি থেকে গতকাল বলা হলো সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে গেছে। যদিও পরেরদিন তারা এটা অস্বীকার করেছে। এই যে ধোঁয়াশা সৃষ্ট করা, এটাকে আমরা মনে করি, এ মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হিসেবে।
এদিকে একযুগেরও বেশি সময় পরও হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ায় হতাশা জানিয়েছেন সাগরের মা সালেহা মনির। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা সব সময়ই ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু বিচার পাচ্ছি কোথায়? তার অভিযোগ, এ হত্যাকান্ডের পেছনে বড় কেউ রয়েছে। তাই এতদিন এটি প্রকাশ করা হয়নি। যদি কোনো চোর বা ডাকাত এটি করত, তবে অনেক আগেই এটি প্রকাশ পেত। তিনি আরো বলেন, আমি তদন্তকারীদের একটা কথাই বলেছি, চুরি বা ডাকাতির অজুহাত দিও না। আমি সেটা মেনে নেব না। পিবিআই এখন তদন্ত করছে। তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। দেখা যাক তারা কতদূর তারা কী করতে পারে।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৬ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরে চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়। টাস্কফোর্সের অন্য তিন সদস্য হলেন পুলিশ সদর দফতর ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ থেকে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন করে দুজন এবং র্যাব থেকে পরিচালক পদমর্যাদার একজন। তবে ৬ এপ্রিল উচ্চ আদালতে অবকাশকালীন ছুটি থাকায় এ বিষয়ে তখন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তার ধারাবাহিকতায় ২১ এপ্রিল এটি আবার আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, কী পরিমাণ তদন্ত করা হয়েছে। কী অগ্রগতি আছে, এই মর্মে একটি আংশিক রিপোর্ট আমাদের দেখিয়েছেন (রাষ্ট্রপক্ষ)। কিন্তু যেহেতু আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, তদন্ত চলমান। এ জন্য সে রিপোর্টের কপিটি আইনিভাবে পাইনি। আদালতেও জমা না দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। তিনি (রাষ্ট্রপক্ষ) আদালতকেও এটি আশ্বস্ত করেছেন তদন্ত চলছে, তদন্তের অগ্রগতি আছে। বেশ কিছু কাজ করা হয়েছে। আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ডিএনএ টেস্টের জন্য অনুরোধ পাঠানো হয়েছে। এগুলো আসার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন। একজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নয় মাস সময় চাওয়া হয়েছে। আমরা তিন মাস সময়ের কথা বলেছিলাম। আদালত ছয় মাস সময় মঞ্জুর করেছেন। পরবর্তী ২২ অক্টোবর দিন রেখেছেন। আমরা আশা করব, এ সময়ের মধ্যে বা তার আগে তদন্ত শেষ হলে রিপোর্ট আদালতে দায়ের করবেন।
শিশির মনির বলেন, রহস্য উন্মোচনের জন্য ওনারা মনে করছেন আরো সময় প্রয়োজন। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, তারা খুব আন্তরিক। বসে নাই। ১২ বছর আগের ঘটনা হওয়ার কারণে অনেক কিছু হারিয়ে (ডিসঅ্যাপিয়ার) গেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলার চেষ্টা করেছে নেক কিছু ডিসঅ্যাপিয়ার হয়ে গেছে। অনেক দিনের আগের নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডিসপ্লেস হয়ে গেছে।
প্রথমে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এক কর্মকর্তা। একই ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব)।
২০১২ সালে হত্যাকান্ডের পর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতার নিয়ে জনস্বার্থে রিট করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। সেই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জারি করা রুলে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের খুনিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
https://slotbet.online/