পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও এই মসলা জাতীয় উদ্ভিদটি নিয়ে দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট তৎপরতা। পেঁয়াজ একটি মশলা জাতীয় উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক নাম এলিয়াম সেপা। রসুন, শ্যালট, লিক, চাইব এবং চীনা পেঁয়াজও একই উদ্ভিদ। বাংলাদেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। চহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় প্রায় সমপরিমাণ। প্রতি বছর উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু পেঁয়াজ সংক্ষণে ব্যবস্থানার অভাবেই প্রতি বছর সংকট দেখা দেয়। এছাড়া পেঁয়াজ বাণিজ্য নিয়ে দেশি-বিদেশি চক্র সক্রিয় থাকার কারণে পেঁয়াজের বাজার ঘিরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। বিশ্বে মসলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পেঁয়াজ। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২.৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয় এবং পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় ৩৪ লাখ টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের অধিকাংশই চাষ করা হয় ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা এবং রাজশাহী জেলায়। অনিন্ত্রিত বীজ বাজার, ফসলের ন্যায্যমুলা না পাওয়া বাংলাদেশের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য দীর্ঘদিনের একটি অলিখিত শোষণ-বঞ্চনার বাস্তবতা। কৃষি নির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী কৃষক। পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকের জন্য বিভিন্ন সেইফ গার্ডিং বা সুরক্ষা স্কিম থাকলেও বাংলাদেশে এখনী পর্যন্ত তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চমুল্যে বীজ, সার, শ্রমিকের মজুরি, সেচ, কীটনাশক, ফসল তোলা এবং বিক্রির প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক নানা বৈরিতা, দুর্যোগ পেরিয়ে এসে ফড়িয়াবাজি আর ফসলের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট এর কারসাজিতে ভুগতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়ন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দির্যোগ, মহামারি- সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষের টিকে থাকার মূলে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ নীতিনির্ধারকদের অবহেলার শিকার হয়ে কৃষককেই সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বলছিলেন, বাংলাদেশ সেফ এগ্রো ফুড এফোর্ট ফাউন্ডেশনে চেয়ারম্যান ড. এম জয়নুল আবেদীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, কেবল পেঁয়াজ নয়, গোটা কৃষি ব্যবস্থাপনায় সময়োগী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। দেশে পেঁয়াজের যথেষ্ট উৎপাদন হলেও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে একটা মোটা দাগের পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক কৃষিপণ্যের যথেষ্ট উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অপ্রতুলতা রয়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সঠিক গবেষণার ভিত্তিতে সংকট মোকাবিলায় আন্তরিক হতে হবে। হিমাগারের অভাবে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে আমদানির নির্ভরতা বেড়ে যায়। কৃষ্টি নির্ভর বাংলাদেশের এই সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। ফসলের উৎপাদন যত ভালোই হোক না কেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকের জন্য তা সোনার ফসল হয় না, বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এবারের মৌসুমে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। বাম্পার ফলন হয়েছে আলুর। এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২২-২৫ টাকা হলেও কৃষকদের তা মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক ফসল আড়তে ফেলে আসছেন, গরুকে খাওয়াচ্ছেন, এমন নানা খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক জানায়, এবারে শীতে ও রমজান মাসে সবজির দাম সাম্প্রতিক বছরের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকায় ভোক্তারা স্বস্তি পেলেও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় এর মাশুল দিতে হয়েছে কৃষককে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার বহনে নানাভাবে ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। ঋণ শোধ করতে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কৃষক ফসল বিক্রি করে দেন। আবার, বাজারে দাম উঠা পর্যন্ত ফসল ধরে রাখার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নেই, ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত পচনশীল কৃষি পণ্য বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। আলু সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ৩৬৬টি হিমাগার থাকলেও সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। কৃষিপণ্য বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতিবছর ২০-৪৪ শতাংশ সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণের সংকট নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে একাধিকবার সংবাদ হয়েছে। একনিকে হিমাগারের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকেরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বছর টমেটোর বাম্পার ফলন হলেও একইভাবে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণের অত্যাধিক বায় এবং হিমাগার না থাকার কারণে অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই টমেটো তোলেননি। ফলে ক্ষেতেই পড়ে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ টমেটো। ভালো ফলন হবার পরেও সবজি সংরক্ষণ ও মূল্য সংকটের এই দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কৃষক ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। দুর্গম উৎপাদনস্থল, ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি, বিশেষ করে পাহাড়ি ও হাওড় এলাকায় পরিবহন সংকট, অজুর সড়ক অবকাঠামো এবং পণ্যের গুণমানজনিত সমস্যাসহ বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ক্ষুর কৃষকের ফসলের মূল্য বঞ্চনায় নিয়ামক হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন প্রণয়নের তিন বছরের মাথায় কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা তৈরি হয়, যেখানে চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মুনাফার একটি কাঠামো ঠিক করা আছে। এছাড়া বাজারভিত্তিক আলাদা কমিটি গঠন এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই মুনাফার হার নিরীক্ষা ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই বিধিমালার কার্যকর কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না বলে জানিয়েছেন বক্তরা। এসব বিষয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেফ এগ্রো ফুড এফোর্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. মুহা. জয়নুল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক, ড. শোহিদা সুলতানাসহ ব্যাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের নেতৃবৃন্দ উপস্থত ছিলেন। বিভিন্ন কৃষিপণ্যে ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেলেও কৃষকদের উৎপাদন খরচও উঠছে না বলে জানিয়েছে ব্যাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক-খানি। সংগঠনটি বলছে, কৃষকের প্রয়োজন ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য, ব্যবসায়ী চায় বেশি লাভ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার হাতে যেতে বেশ কয়েকদফা হাতবদলের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভ পেলেও সবচেয়ে কম মূল্য পান কৃষক। এমনকি উৎপাদনের খরচ ও উঠে আসে না।
https://slotbet.online/