স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় নির্বাচনগুলো দেশের গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক ও চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে সম্ভাবনার কথা বলা হলেও, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে জোড়-বিজোড় সালের জয়-পরাজয়ের রাজনৈতিক গণিতকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি—এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, জোড় সালের নির্বাচনে সাধারণত আওয়ামী লীগ জয়ী হয়, আর বিজোড় সালে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে বিএনপি। সেই ভাবনা থেকেই বিজোড় সালে নির্বাচন আদায়ে মরিয়া খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটি।
যদিও শুক্রবার ১৩ (জুন) লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সেই বৈঠক শেষে বিএনপির হাই কমান্ড তারেক রহমানের পক্ষ থেকেও আগামী বছর অর্থাৎ জোড় সাল ২০২৬ এর ফেব্রুয়ারিতে রমজান শুরুর আগে ভোটের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, শিগরই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।
এদিকে,ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। আগামী নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে ঐতিহাসিকভাবে গত ৫৪ বছরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-ই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জোড় সালের নির্বাচন সাধারণত আওয়ামী লীগের জন্য সৌভাগ্যজনক, আর বিজোড় সালের নির্বাচন বিএনপির জন্য অনুকূল।
দেশের ১২টি জাতীয় নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সাধারণত জোড় সালে জেতে, আর বিএনপি বিজোড় সালে। তবে আওয়ামী লীগ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল একটি বিজোড় বছরেই—১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দলটি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। ভোটগ্রহণে অংশগ্রহণের হার ছিল ৫৪.৯ শতাংশ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল পরিবর্তিত হয়। এরপর বাংলাদেশ পড়ে সামরিক শাসনের অধীনে। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এতে বিএনপি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫১.৩ শতাংশ। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২, জাসদ ৮, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০, ন্যাপ (মোজাফফর) ১, জাতীয় লীগ ২, গণফ্রন্ট ২, সাম্যবাদী দল ১, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১, জাতীয় একতা পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়ী হন।
তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় লে. জে. (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১,৫২৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয় পায়। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৬১.১ শতাংশ। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করায় এটি একতরফা নির্বাচনে পরিণত হয়।
এরশাদ ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন, মাত্র দুই বছরের মাথায়। প্রধান সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় পার্টি এককভাবে অংশ নেয় এবং ২৫১টি আসনে জয়ী হয়। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৫২.৫ শতাংশ—যা ভোটারদের অনাগ্রহ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতিফলন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, যা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৫৫.৪ শতাংশ। বিএনপি ১৪২টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর থেকেই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, একমাত্র জোড় সালে বিএনপির করা নির্বাচন। তবে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় বিএনপি এককভাবে ৩০০টি আসনে জয়ী হয়। তবে তীব্র জনআন্দোলনের মুখে এই সংসদ মাত্র কয়েক মাস টিকে থাকে। এরপর ১২ জুন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সপ্তম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসে। এটি ছিল একটি জোড় সাল, এবং এরপর থেকে আওয়ামী লীগের জোড় সালে জয়ের যাত্রা শুরু হয়।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর। এতে বিএনপি ১৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। এটি একটি বিজোড় সাল, বিএনপির জন্য অনুকূল। এই নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তাদের অধীনেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ জয় পায়—এককভাবে ২৩০টি আসন। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যা ছিল বেশ বিতর্কিত। বিএনপি অংশ নেয়নি। ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় এবং মোট ২৩৪টি আসনে জয়ী হয়ে আবারো সরকার গঠন করে। ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩৯.৫৮ শতাংশ।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও মাত্র ৭টি আসনে জয়ী হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ২৫৮টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়। ৯ জানুয়ারি ফলাফলের গেজেট প্রকাশিত হয় এবং ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। পরে ৬ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
মূলত, ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আর কোনো বিজোড় বছরে জয়ী হয়নি। অন্যদিকে বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ব্যতীত জোড় সালের নির্বাচনে জিততে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পালাবদলে সালটি জোড় না বিজোড়, সেটিই এক ধরনের ‘রাজনৈতিক গণিতে’ পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এই মুহুর্তে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন নিয়ে জোড় সাল ২০২৬ এ ভোট আয়োজনের বিষয়ে সম্মতি দিলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সেটি ২০২৫ এ এগিয়ে আনার দাবি তুলবে। এক্ষেত্রে ইউনূস সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করে সেগুলোর ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে চায় বিএনপি। যখনই দলটি সুযোগ পাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচন আদায় করে নিবে বলেও মত প্রকাশ করেছেন অনেকে।
এদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, নির্বাচন বিষয়ে তাঁর অবস্থান আগের মতোই রয়েছে। তিনি মনে করেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়া উচিত। সর্বশেষ ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ তিনি এটি বলেছেন। এমনকি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জেনারেল ওয়াকার বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচনের কথা।
https://slotbet.online/