ইতিহাস একটি জটিল আয়না। কখনো তা স্পষ্ট করে সত্যের প্রতিফলন ঘটায়, আবার কখনো তা আবছা করে রাখে অনেক প্রশ্ন। ইসলাম—বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যার শুরু হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীর আরব ভূমিতে। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে? মক্কা? নাকি পেত্রা?
এই প্রশ্নটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় নতুন আলোড়ন তুলেছে। কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণার তথ্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।
ইসলামের প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নবুয়তপ্রাপ্তি ঘটে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, যখন তিনি জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে প্রথম ওহি লাভ করেন। এরপর শুরু হয় ইসলাম প্রচারের সংগ্রাম।
ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি প্রথমে মক্কায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হন এবং পরে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করেন ইয়াসরিবে, যেটি পরে মদিনা নামে পরিচিত হয়।
মক্কায় অবস্থিত কাবা শরিফ—মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। যা এই শহরের গুরুত্বকে আরও গাঢ় করে তোলে। কুরআন, হাদীস এবং প্রাচীন ইসলামী ইতিহাস—সবই মক্কাকেন্দ্রিক বর্ণনা উপস্থাপন করে।
তবে গত কিছু বছর ধরে একদল গবেষক এবং ইতিহাসবিদ—বিশেষত পশ্চিমা লেখক ড্যান গিবসন দাবি করেছেন, ইসলাম আদতে মক্কা থেকে নয়, বরং জর্ডানের দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন নগরী ‘পেত্রা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
ড্যান গিবসনের যুক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো—সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর মসজিদগুলোর কিবলা অর্থাৎ নামাজের দিক বেশিরভাগই পেত্রার দিকে মুখ করা ছিল, মক্কার দিকে নয়।
কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মক্কার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য যেমন নদী, পাহাড়, কৃষিজমি—তা বর্তমান মক্কার সাথে মেলে না। বরং পেত্রার আশপাশে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
গিবসনের মতে, পেত্রা প্রাচীন বাণিজ্যিক রুটের কেন্দ্রস্থলে ছিল, যেখানে বিভিন্ন সভ্যতা মিলিত হতো। পেত্রা ছিল একটি সমৃদ্ধ নগরী, যেখানে ছিল বিশাল জলাধার, খনিজ সম্পদ ও স্থাপত্য কীর্তি। মক্কা ঐ সময় ছিল অপেক্ষাকৃত নির্জন ও অগুরুত্বপূর্ণ। তখনকার ‘বাকার’ বা ‘মকার’ নামক শব্দগুচ্ছ পেত্রার সাথেও মিলে যেতে পারে। এ নিয়ে বিতর্ক চলছেই।
তবে ইসলামী পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্বকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিত্তিহীন বলে মনে করেন।
কুরআন, হাদীস, সিরাতুন নবী এবং সাহাবীদের বর্ণনায় মক্কার ভূগোল, আবু জাহলের মতো মক্কার নেতৃবৃন্দ, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশদের বর্ণনা স্পষ্ট। ইসলামী ইতিহাসে পেত্রার উল্লেখ নেই।
কিছু গবেষণায় মক্কা শহরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে ষষ্ঠ শতকের আরব মানচিত্রে, যদিও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত নগরী না হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছিল।
ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নির্দিষ্ট মসজিদের কিবলা দিক ভুল হলে তা কেবল স্থপতির ভুল বা ভৌগোলিক অজ্ঞতা। এর মানে এই নয় যে গোটা ধর্মের ভিত্তি ভুল স্থানে গড়ে উঠেছে।
পেত্রা নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর নগরী। ২০০০ বছরের পুরোনো এই শহর ছিল নাবাতীয় রাজ্যের রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই শহর পরবর্তীতে রোমান ও বাইজান্টাইন শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর জলব্যবস্থা, সমাধিসৌধ এবং মন্দির—সবই প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী।
তবে প্রশ্ন হলো, সপ্তম শতকে কি এখানেই ইসলামের জন্ম হয়েছিল? সাম্প্রতিক উপগ্রহ চিত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এবং মধ্যপ্রাচ্যের পুরাতন বাণিজ্যপথের মানচিত্র পরীক্ষা করলে দেখা যায়, মক্কাও একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক স্টপ ছিল। হয়তো তা পেত্রার মতো বড় শহর ছিল না, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
ইতিহাস যেমন তথ্যনির্ভর, তেমনি তা ব্যাখ্যার বিষয়ও বটে। “ইসলামের উৎপত্তি কোথায়?” এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে যুক্তি দাঁড় করান।
মক্কার পক্ষে রয়েছে শতাব্দীজুড়ে গড়ে ওঠা ধর্মীয় ঐতিহ্য, মুসলিম বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ইতিহাস, এবং প্রাচীন আরবি দলিল। পেত্রার পক্ষে রয়েছে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক ইঙ্গিত, মানচিত্রগত মিল ও ভূগোলগত প্রশ্ন।
পেত্রা বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর ওয়াদি মুসার ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ২৪০০-২২০০ বছর আগে এটি ছিল নাবাতীয় রাজ্যের রাজধানী। পেত্রা নগরী মূলত একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ ছিল।
পেত্রা বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে যা কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া, মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল।
গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের দেয়ালের গায়ে খোদাই করা সেই প্রাচীন দালানগুলো, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভাণ্ডার নামেও পরিচিত। আরও রয়েছে একটি অর্ধগোলাকৃতির নাট্যশালা, যেখানে প্রায় ৩০০০ দর্শক একসাথে বসতে পারে।
পেত্রা নগরী ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারপাশে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরনাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকাবা ও লিউস এবং মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা।
রোমান শাসনের সময় সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত গুরুত্ব হারাতে থাকে। ১০৬ সালে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির প্রভূত উন্নতি হলেও পরবর্তীতে প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ‘পামিরা’ পেত্রার অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে নিলে পেত্রার গুরুত্ব কমে যায়।
মুসলমানরা এটিকে তাদের দখলে নেয় সপ্তম শতকে এবং পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকে আবার ক্রুসেডাররা এটিকে দখল করলে ধীরে ধীরে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ধ্বংস করে দেয় এর দালানগুলো এবং নষ্ট করে দেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও।
মধ্যযুগে পেত্রার ধ্বংসাবশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ত্রয়োদশ শতকের দিকে পেত্রা দেখতে যান ইজিপ্টের সুলতান বাইবারস। বহু বছর অজানা থাকার পর, এই প্রাচীন শহরটিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডভিগ বুরখার্ট, ১৮১২ সালে।
https://slotbet.online/