একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধ আতিকুর রহমান। উত্তাল সেই মার্চে ঢাকার সন্নিকটে নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে যাননি এই তরুণ। দেশ মাতৃকার তরে বিলিয়ে দিয়েছেন প্রাণ। কিন্তু সেটা নিজ গ্রামের খুব কাছাকাছি স্থানেই। মায়ের হাতের মেরাপিঠা তাঁর কপালে জুুটেনি। মহান এই মুক্তিযোদ্ধাকে কবরস্থ করতে না করার বেদনাহত হৃদয় নিয়েই মারা গেছেন স্কুল শিক্ষক পিতা, আর আমৃত্যু মায়ের চোখে জল পড়েছে। তিনিও চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। শুধু এই আক্ষেপটুকু নিয়েই, পাগলাটে মেধাবী ছেলাটার লাশও দেখতে পারেননি। সেই লাশ খেয়েছে শেয়াল-শকুন, ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল নদীতে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আতিকের বোন শাহনা হক লিখেছেন সেই সময়ের ঐতিহাসিক সত্য বয়ান। বাংলা অ্যাফেয়ার্সের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো তার লেখাটি।
ভৈরবের কুখ্যাত রাজাকার মমতাজ পাগলাকে খতম করার অপারেশনে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধা আতিক এবং মুক্তিযোদ্ধা নূর এর সর্বশেষ যুদ্ধের কাহিনী। যাদের নামে ভৈরব পৌর পাঠাগারের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আতিক-নূর পাঠাগার। আমরা ভৈরবের অনেকেই তাদের কে চিনি না বা তাদের ব্যাপারে জানিনা। আজকে জানবো তাদের ব্যাপারে।
আমার অত্যন্ত প্রিয়, আমার মেজ ভাই আতিকুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ। তাকে নিয়ে আমাকে কোনোদিন কিছু লিখতে বলা হবে ভাবিনি।
আমরা ছিলাম ৮ ভাইবোন। আমার বড় দুই ভাই, আমার পরে পরপর তিন ভাই, তারপর এক বোন, সবশেষে ছোট ভাই রানা। বাবা ছিলেন আজিমউদ্দিন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মা গৃহিণী। এই ছিল আমাদের সুন্দর সুখী পরিবার।
আতিক ভাইসাবের জন্ম ১৯৫১ সনের ১৮ই আগস্ট আমাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার সররাবাদে। সেটা ছিল ভাদ্রমাস। ছোটবেলা থেকেই খুব চঞ্চল আর রাগী ছিলেন বলে আম্মা বলতেন, ভাদ্রমাসে যারা জন্মায় তারা নাকি এমনই হয়। যথারীতি স্কুল শুরু হলো। তাঁর প্রথম স্কুল ছিল কিশোরগঞ্জের পিটিআই স্কুল। আমাদের সবার স্কুলও কিন্তু এটাই ছিল। তারপর ১৯৫৯ সনে আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। পড়ালেখায় সবসময়ই তিনি ভালো ছিলেন। খুব কম পড়ালেখা করে ভালো ফলাফল অর্জন করতেন। স্কুলের কাব/স্কাউটের একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ১৯৬৭ সনে করাচী গিয়েছিলেন দশ দিনের 4th Pakistan National Scout Jamboree তে অংশগ্রহণ করতে। ১৯৬৮ সনে SSC পাশ করে, ১৯৭০ সনে গুরুদয়াল কলেজ থেকে HSC পাশ করে সেই বছরেই ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। থাকার জায়গা হলো জিন্নাহ হলে (বর্তমান সূর্যসেন হল)। পড়াশোনা চলতে থাকলো যেমন চলার তেমনি। কিন্তু দেশ তখন অস্থির। স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে। শুধু তরুণরাই নয় সব বাংগালীর রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। এখনি কিছু একটা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও ক্ষমতা পাবেন না তাই কি হয়? তার পরের ইতিহাস সব্বাই জানি আমরা।
ভাইসাব ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ গেলেন খুব সম্ভবত মার্চের প্রথম সপ্তাহে। কারণ সবাই ইতিমধ্যে ক্লাস বর্জন করছে। ঢাকায় থেকে কী লাভ? বড়ভাই এলেন না। তিনি থাকতেন ফজলুল হক হলে। কি সমস্যা! শুরু হয়ে গেলো ২৫ মার্চের বিভীষিকা। আমরা তো বড়ভাই এর কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না। আম্মার কান্না এখনো চোখে ভাসে। শেষ পর্যন্ত খবর পাওয়া গেলো বড়ভাই বাড়িতে (নরসিংদী) এসেছেন, সার্জেন্ট আঃ জলিল (ফুফাতো ভাই) ভাইয়ের সাথে তার মোটরবাইকে করে।
এর মাঝে কিশোরগঞ্জে এলো পালিয়ে আসা ইস্টবেঙ্গলের বিরাট সৈন্যদল। প্রায় ১১০০ সৈন্য। এদের জায়গা হলো আব্বার স্কুলে (আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে)। সারা শহরে হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা। এত এত সৈন্যের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন কাজ। পরে যারা পাক সেনাদের পাচাটা পোষা প্রাণী সেজেছিল তারা কি গরমই না ছিল তখন! নাম প্রকাশ না করে বলছি এদের একজন ছিলেন এক মওলানা এবং তার দুই ছেলে। তিনি বলছিলেন আমার এই দুই ছেলেকে আমি দেশের জন্য কোরবানী করে দিব। সেই বাপ বেটারা তাদের আত্মীয় স্বজনসহ কী করেছে তা কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের একটি জঘন্য এবং ঘৃন্য অধ্যায় হয়ে আছে। যাক সে কথা!
তারপর এপ্রিলের ১৪ তারিখ, ১লা বৈশাখ পাক হানাদার বাহিনী ভৈরবের দখল নিল। সেদিনই আতিক ভাইসাব ১৮ জনের একটি দলের সাথে রওয়ানা হয়ে গেলন। স্টেশনে আব্বা, সুশীল স্যার তাঁদেরকে বিদায় দিয়ে এলেন। আম্মা অঝোর ধারায় কাঁদছেন আর বলছেন, আমার ভাদ্র মাসে জন্ম নেয়া ছেলেকে কেন যুদ্ধে পাঠালেন। তারপর শুনেছি তাঁরা ভৈরবের আগেই ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁরা পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে প্যারাসুটে করে নামতে দেখেছেন। কুলিয়ারচরে তাঁরা নদী পার হয়ে হেঁটে পরদিন ভোরে সিলেটের তেলিয়াপারা সীমান্তে পৌঁছেন। ১৬ই এপ্রিল আগরতলার সিমলায় মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেন। এখানে প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ করে চলে যান আসামের অম্পিনগর ক্যাম্পে। এ পর্যন্ত জেনেছিলাম বীর প্রতীক রফিক ভাই এর কাছ থেকে।
এরপর তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, কারণ পুরো দলটিকে দুই ভাগে ভাগ করতে হয়েছিল। সময় তার মতোই চলতে থাকলো। আমরা তো পুরো অন্ধকারে। আমরা কিশোরগঞ্জ থেকে পালিয়ে চলে গেছিলাম ভাটি অঞ্চলের পানহার নামক স্থানে, আব্বার ছাত্র বোর্ড অফিসের হাশেম ভাইয়ের বাড়িতে। আমরা কিভাবে আমাদের গ্রামের বাড়ি পৌঁছালাম তা লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে।
জুন মাসের শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে আতিক ভাইসাবের কোনো খবরই ছিলনা। তবে আব্বা প্রতিদিনই অপেক্ষায় থাকতেন। বলতেন, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিনই দেশে ঢুকছে। আমার আতিকও আসবে শীঘ্রই। তারপর এলো সেই দিন, জুনের ২৮ তারিখ, সোমবার, রাত প্রায় ১২ টার মতো হবে। গ্রামের রাত, বারোটা মানে নিশিরাত। ভাইসাব এসে হাজির, সাথে বন্ধু ফরিদ, ভৈরব বাড়ি। ছোট ভাই বোনেরা ঘুমিয়ে আছে। সবাইকে হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেখে নিলেন এক ঝলক। রানা ছোট, তাই এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলেন। রানা চোখ খুলেই বলে উঠল ‘দাদা তুই?’ আমার ভাই এর চুল ঘাড় ছাড়িয়ে গেছে। দাড়ি গোঁফ মিলিয়ে এক অসাধারণ রূপ। ভাইসাবের চুল ছিল ভীষণ কালো আর অসম্ভব কোঁকড়া। পরনে একটা ব্লু সার্ট, এত ময়লা হয়েছে যে শার্টের আসল রং আর বুঝা যায় না। একটা লুংগি দুই ভাঁজ করে একটা গিট দেয়া, খালি পা। বৃষ্টি, কাদায় পা দু’টোতে ঘাঁ হয়ে গেছে। বগলে স্টেনগান। আমরা সেটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। একবার ট্রিগারে চাপ দিলেই নাকি ২৭টি গুলি বের হয়ে যায়।
তারপর হাত মুখ ধুয়ে বন্ধু ফরিদকে নিয়ে খেতে বসলেন।খাবার আয়োজন তেমন কিছুই ছিলো না। যুদ্ধের বাজার, গ্রামের বাড়ি, নিশিরাত সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা। তখন গ্রীষ্মকাল। আমাদের বাড়িতে ভালো জাতের প্রচুর আম গাছ আছে। আম প্রায় শেষ হওয়ার পথে। আব্বার চিন্তার শেষ নেই। এবার আম খেতে পারলো না তাঁর যুদ্ধে চলে যাওয়া ছেলেটি। তিনটি মাত্র আম তখনও ছিল। তাই দুধ দিয়ে কি তৃপ্তি করেই না খেলেন ভাই আমার! কত যে গল্প হলো। আম্মা বললেন, তুই কি জানিস আমার এতদিনের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে? অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন আম্মা। ভাইসাব বললেন, আম্মা চোখ মুছেন, কাঁদবেন না। দেশ স্বাধীন হোক, তারপর যা সাথে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন ওগুলোও আগুনে পুড়িয়ে ফেলব। সবকিছুই আবার নতুন করে শুরু করবো।
খাওয়া শেষে বন্ধু ফরিদ চলে গেলেন ক্যাম্পে। সেটি ছিলো বাড়ির উল্টো দিকে, নারায়ণপুর বাজারে। হাঁটা পথে যেতে দশ মিনিটের মত লাগে। ভাইসাব শুয়ে পরলেন আম্মা আর আব্বার মাঝখানে। দুইজনের দুই হাত ভাইসাবের প্রশস্ত বুকের উপর। মাথার পেছনে তার অস্ত্র। অনেক রাত। বেশিক্ষণতো আর ঘুমোনোর উপায় নেই। কাকপক্ষী জাগার আগেই ফিরে যেতে হবে ক্যাম্পে। ফজরের আযানের আগেই আব্বা আম্মা বিদায় দিলেন ভাইসাবকে। এগিয়ে দিতে সাথে গেলেন বড়ভাই। বলে গেলেন জুলাই এর চার তারিখে আসবেন আবার।
তাঁর যে আর ফিরে আসা হলো না!
তাঁর ট্রেনিং ছিলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। আমাদের গ্রামের উত্তর দিকে একটি নদী আছে। নদীর অপর পারে কালিকাপ্রসাদ, আমাদের গ্রাম থেকে দুই মাইল দূরে। মমতাজ পাগলা নামে পাকসেনাদের এক দোসর সেখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে, মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে দেয়া থেকে শুরু করে গরু, ছাগল নিয়ে যাওয়া, লুটপাট করাসহ কী না করেছে সে? তাই ওখানকার মানুষের দাবী ছিল মমতাজ পাগলাকে যে কোনো মূল্যে খতম করতে হবে। ক্যাম্পের যোদ্ধারা ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু কে কে যাবেন এই অপারেশনে? ভাইসাব যদিও অন্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিলেন, তবুও তিনি নাছোড়বান্দা এটা তাকেই করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রাজী হয়ে গেলেন। সাথে যাবেন নুরু চাচা (সম্পর্কে আমাদের চাচা হন) আর মোহন (সম্পর্কে ভাই হন)। তাদের কোনো ট্রেনিং না থাকলেও তাঁরা ছিলেন প্রচণ্ড দুঃসাহসী। আমাদের বাড়ি থেকে দুই শত গজ দূরে একজনের বাড়ি, তারও দুই শত গজ দূরে অন্য জনের বাড়ি। তিনজনই রওয়ানা হলেন নৌকায়। ভাইসাব নাকি গান গাইছিলেন, ‘ফিরিয়া ডেকোনা মহুয়া বনের পাখি’। ভাইসাব এমনিতে গান গাইতেন না, একটু আধটু সুর ধরতেন মাঝে মধ্যে। আব্বা বলতেন, আতিক তো দেখি ‘সায়গলের’ মতো গান গায়।
ভাইসাবের সাথে থাকবে মরিচের চারা। সেগুলো একটা ঝাঁকাতে থাকবে, তার নীচে থাকবে স্টেনগান। নুরু চাচা থাকবেন দরজায়, আর মোহন ভাই একটু দুরে দাঁড়িয়ে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেবেন। মুক্তিযোদ্ধারা আগেই জেনেছিল ঐ দিন অর্থাৎ ৪ঠা জুলাই মমতাজ পাগলারা পেঁয়াজহাটার ছবিঘর সিনেমা হলের কাছে একটা ঘরে মিটিং করবে। সেদিন ছিল মমতাজ পাগলার চার ভাই, এক ছেলে, এক ভাতিজা। সবকিছু ঠিকঠাক। শুরু হলো ফায়ার। ভাইসাব তাঁর কাজ খুব সুন্দর ভাবে শেষ করেছেন। সাতজন মানুষের কাতরানি, এতো রক্ত দেখে নুরু কাকা নার্ভাস হয়ে যান। এই কারণে তাঁর ছোঁড়া গ্রেনেডটি ঠিক জায়গায় পৌঁছেনি। গ্রেনেডটি ভাইসাবের খুব কাছেই বিস্ফারিত হয়ে যায়। সেটির আঘাতে তিনি মারাত্মক ভাবে আহত হযে যান। নুরু কাকাও আহত হন। তবে তিনি দৌড়ুতে পারছিলেন। মোহন ভাই দৌড়ে এসে ভাইসাবকে কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু ভাইসাব নাকি বার বার তাঁকে বলছিলেন, ‘মোহন ভাই আমাকে রেখে আপনি পালিয়ে যান। আমার সময় শেষ, আপনি বাঁচুন।’ মোহন ভাই তাই করলেন।
নুরু কাকা দৌড়ে কোনোরকমে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। বাড়ির লোকেরা তাঁকে চিকিৎসা করাবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু তারা ডাক্তার আনার কথা বলে নিয়ে এলেন পাক আর্মিদের। ওরা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে ভৈরব রেল হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করলো। তিনি টুঁ শব্দটি করেন নি। এক সপ্তাহ পর হাসপাতালের পাশে কবর খুঁড়ে সেখানে তাঁকে নামিয়েও চেষ্টা করলো কথা বের করার জন্য। তাতেও কাজ হলো না দেখে গুলি করে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। গুলির আগেও নাকি জয় বাংলা শ্লোগান ছিল নুরু চাচার মুখে।
মারাত্মকভাবে আহত ভাইসাবের প্রাণপাখি কতক্ষণ পর এই মাটির ধরা ছেড়ে যেতে পেরেছিল তা কখনও জানা যায়নি। শুনেছি শেষ পর্যন্ত তাঁর দেহাবশেষ (শকুন, শেয়াল, কুকুরে খেয়ে যা অবশিষ্ট ছিল) মেঘনা নদীতে ফেলে দিয়েছিল।
মমতাজ পাগলাকে খতম করার অপারেশনের তিনজন মুক্তিযোদ্ধার মাত্র একজন (মোহন ভাই) অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন।
৪ঠা জুলাই আমরা তো বাড়িতে অপেক্ষা করছি। আজ ভাইসাব আসবেন। তার একটি প্রিয় খাবার ছিল মেরা পিঠা দিয়ে মুরগির মাংস খাওয়া। নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন মেরা পিঠা! সব আয়োজনই তৈরী আছে। চালের গুঁড়া তৈরী হয়ে গেছে। মুরগি তখনও জবাই করা হয়নি। এর মধ্যেই এ বাড়ি ও বাড়ির লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। সবাই আসছেন, সবাই যেন কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু কেউ বলতে পারছেন না। আবার চলে যাচ্ছেন, আবারও আসছেন। আব্বা জেনে গেছেন কিন্তু আম্মা? আম্মা কি করে জানবেন এই কঠিন সত্য? তাঁর তো হাই ব্লাড প্রেশার। মায়ের মন বলে কথা! কিছু একটা সবাই লুকোচ্ছেন এটা তিনি বুঝে গেছেন। এক সময় তিনি অস্থির হয়ে বললেন, আমার মনে হচ্ছে আমার কাছে কিছু একটা লুকানো হচ্ছে। এর মাঝে কেউ একজন আটকে রাখা মুরগিটা ছেড়ে দিলেন। আম্মা বললেন, এখনি এটা জবাই করার কথা কে ছেড়ে দিল? আব্বা বললেন, আজ আর আতিক আসবে না। তাড়াতাড়ি সবাই তৈরী হয়ে নাও। এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। কেন কি হয়েছে? খারাপ কিছু? আব্বা বললেন, এতো কিছু জানতে চেয়ো না। ছেলে মেয়ে নিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নাও। আপাতত আমরা আব্বার খালাতো ভাই তৈয়ব চাচার বাড়ি যাব। তাঁর বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে ৪/৫ মাইল দক্ষিণে। বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, আঠালো মাটির গ্রামের রাস্তা, হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। ছোট ভাই বোন কারো কোলে, কারো কাঁধে করে নিয়ে রাত ১০/১১টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম তৈয়ব চাচার বাড়ি। এতগুলো মানুষ, এতো রাত, গ্রামের বাড়ি সব মিলিয়ে এক কঠিন সময় আমাদের পার করতে হয়েছিল সেদিন। বাড়িতে দাদা (৯০+) এবং বুবুকে রেখে আসতে হয়েছিল। কারণ হেঁটে ঐ পর্যন্ত যাওয়া তাঁদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে এলাম। আমাদের এতো বড় গ্রাম কিন্তু খুব নিরাপদ ছিল সবসময়। পাক আর্মিদের কোন দোসর এই গ্রামে ছিলনা কখনোই। আমি গর্বিত আমার এই গ্রাম নিয়ে।
চাচার বাড়িতে এক রাত পার হয়ে গেলো। ভোর হতে না হতেই লোকজন এক এক করে আসতে লাগলো। সবাই বুঝে গেলাম আমরা আমাদের এক অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি। পরিবার আমাদের ছোট হয়ে গেলো।
ভাইসাবের খবর জানতে পেরে আম্মার প্রেসার খুব হাই হয়ে গেল। তাঁকে সামাল দেয়া খুব কঠিন হয়ে গেল। আব্বা কেবলই বলছেন, তোমরা যেভাবেই পারো আমার ছেলের Skeletonটা আমাকে এনে দাও। আমি একটা কবর বানাতে চাই। সেটাও সম্ভব হলোনা।
৫/৬ দিন পর চাচার বাড়ি থেকে ফিরে এলাম আমাদের বাড়িতে। গর্বের বিষয় হলো তিনজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন একই গ্রামের এবং তাঁদের বাড়িও ছিল খুব কাছাকাছি। গ্রামের সব মানুষেরই ভয় ছিল আর রক্ষা নাই। যোগাযোগ ব্যবস্থা যেহেতু ভালো, ভৈরব থেকে ৬/৭ মিনিটের মধ্যে পাক সেনারা চলে আসবে। কি আশ্চর্য! কিছুই হয়নি। মমতাজ পাগলাকে খতম করার অপারেশনের তিন মুক্তিযোদ্ধার দুইজন শহীদ হলেন, একজন অক্ষত অবস্থায় ফেরত এলেন। কোন কারণে পাক সেনারা সাহস পেলোনা পাল্টা আক্রমণের।
এই পুত্রশোক নিয়ে আব্বা বেঁচেছিলেন ২০ বছরেরও বেশী সময়। কঠিন কষ্ট বুকে নিয়ে আম্মা বেঁচে ছিলেন ৩২ বছর। দোয়া করি আল্লাহ্ যেন তাদেরকে জান্নতবাসী করেন। আরও দোয়া করি সবদিক দিয়েই যেন দেশের আরো উন্নতি হয়। তাহলেই হয়তো সব শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা একদিন শান্তি পাবে।
শেষ হয়ে গেলো আতিক-নুরু অধ্যায়! কিন্তু এই অধ্যায় কি কখনও শেষ হতে পারে? তাঁদের নশ্বর দেহ এই পৃথিবীতে না থাকলেও তাঁদের কীর্তি কি কখনও শেষ হতে পারে? আতিক-নুরু হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গর্বিত অংশ। তাঁরা বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশে, সারা পৃথিবীর লক্ষ কোটি বাঙালীর হৃদয়ে, চিরদিন।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আতিকুর রহমানের বোন
https://slotbet.online/