জিপিএ-৫ এর ফুলঝুরি থেমে, ফিরেছে নিষ্ঠুর বাস্তবতা

Reporter Name / ২১ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫


১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এসএসসি ফলাফলের মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা ২০০৯ সালের পর সর্বনিম্ন। ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই তা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক, বিশ্লেষণ এবং দায়-দায়িত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এবার দেশের ৩ হাজার ৭১৪টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন।

বোর্ডের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বছর কাউকে বাড়তি নম্বর বা ‘গ্রেস মার্কস’ দেওয়া হয়নি। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে যেসব শিক্ষার্থী সামান্য নম্বর ঘাটতির জন্য ফেল করতো, তাদেরকে পাস করিয়ে দেওয়া হতো বিভিন্ন উদার নীতির মাধ্যমে। কিন্তু এবার সেই পথ থেকে সরে এসে খাতার ‘প্রকৃত মূল্যায়ন’ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।

২০০৯ সালের পর এই প্রথম এত কম পাসের হার। সেবার পাস করেছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। অনেক শিক্ষাবিদ এই পরিসংখ্যানকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলছেন। তাঁদের মতে, এই ফলাফল শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতার প্রকাশ। শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির অভাব, শিক্ষকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং শিক্ষা প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

একজন শিক্ষাবিদ মন্তব্য করেন, “নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করে যারা বোর্ড পরীক্ষায় ফেল করেছে, সেটা শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা নয়; বরং এটি শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা।” অন্য এক শিক্ষা বিশ্লেষক বলেন, “যে শিক্ষার্থী জীবনপ্রথম বড় পাবলিক পরীক্ষায় ফেল করে, সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ফল প্রকাশের পর ব্যাখ্যা দিয়ে তা ‘ইতিবাচক’ হিসেবে তুলে ধরা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।”

শিক্ষা উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, “এবার ফলাফল বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছে। গত ১৬ বছরে ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হতো। সেই রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সঠিক মূল্যায়নের পথে হেঁটেছি।”

তবে শিক্ষা ও গবেষণা সংশ্লিষ্টদের মতে, বাস্তবতা তুলে ধরার নামে ফলাফলের বিপর্যয় ঘটিয়ে দেওয়া সমাধান নয়। বরং কেন এমন ফল হলো, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজন গভীর বিশ্লেষণ এবং একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন।

শুধু পাসের হার নয়, ফলাফলে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যাও কমেছে। যদিও শিক্ষা বোর্ডের কর্তৃপক্ষ এটিকে স্বাভাবিক বলে দাবি করেছে। করোনাকালীন সময়ে যেখানে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজারেরও বেশি, সেখানে এবার তা নেমে এসেছে ১ লাখ ৩৯ হাজারে। অনেকেই এটিকে শিক্ষার প্রকৃত মানে ফেরার ইঙ্গিত বললেও, শিক্ষাবিদদের একাংশ বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে এর কাঠামোগত সমাধান জরুরি।

একইসঙ্গে ফলাফলের এই বিপর্যয়ের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক প্রভাবও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। জানা গেছে, গণআন্দোলন ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে থাকা অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় পরীক্ষায় অংশ নেয়। তারাও পরীক্ষায় খারাপ করেছে, যা ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে।

শিক্ষাখাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘সাফল্যের প্রচার’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবভিত্তিক ফল দেখানো যদি সত্যি হয়, তবে এর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে সংযোজন দরকার ঘাটতির স্বীকারোক্তি এবং তা পূরণের পদক্ষেপ।

অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক মনে করছেন, ফল খারাপ হতেই পারে, কিন্তু ফল খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত না করে এটিকে ‘অর্জন’ হিসেবে দেখানো প্রতারণার শামিল।

শিক্ষাব্যবস্থার শুদ্ধি আনতে হলে প্রথমে ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে, এরপর নিতে হবে সংশোধনের কার্যকর পদক্ষেপ। আর সেই শুরু হতে পারে—এই ফলাফল বিশ্লেষণ থেকে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/