নৌকার ঘাটে এনসিপির ঢেউ – Bangla Affairs

Reporter Name / ২ Time View
Update : রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫


নৌকা; শুধু একটি নির্বাচনী প্রতীক নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট যখন লাঙ্গল প্রতীক নিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়, তখন শুরু হয় নৌকা প্রতীকের রাজনৈতিক যাত্রা। তখন থেকেই নৌকা প্রতীক হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গের জনগণের প্রত্যাশা ও পরিবর্তনের প্রতীক। এর ধারাবাহিকতায় আজও নৌকা রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ব্রিটিশ আমলে কৃষক প্রজা পার্টি লাঙ্গল প্রতীক ব্যবহার করায় যুক্তফ্রন্টকে সেই প্রতীক দেওয়া হয়নি। ফলে তারা নৌকা প্রতীক গ্রহণ করে। ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট বিলুপ্ত হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এই প্রতীকটি নিজেদের করে নেয়।

১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং বিজয় অর্জনের মাধ্যমে তা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বাধীনতার পর নৌকা হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতীক।

পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের সদস্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ এই প্রতীকেই অংশগ্রহণ করে নির্বাচনে।

আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ
আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ১১টি রাজনৈতিক দল নৌকা প্রতীক ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২৩ সালে ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলসমূহ; জাসদ, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), ওয়ার্কার্স পার্টি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিজেদের প্রতীকের পরিবর্তে নৌকা প্রতীক গ্রহণ করে।

এমনকি দলীয় বিরোধ নিরসনে ২০২৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা আর দলীয়ভাবে কাউকে নৌকা প্রতীক দেবে না। এর ফলে প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে অন্য প্রতীকেও নির্বাচন করতে পারেন।

নতুন করে প্রতীক-রাজনীতির জটিলতা তৈরি হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সঙ্গে বিরোধের মাধ্যমে।
এনসিপি নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছিল, শাপলা প্রতীককে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকটি বাদ দিতে। তাদের দাবি, যেহেতু আওয়ামী লীগের নিবন্ধন আপাতত স্থগিত রয়েছে, তাই তাদের প্রতীক তফসিলভুক্ত থাকা সংবিধান বিরোধী।

তবে নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নৌকা প্রতীক তফসিলে বহাল থাকবে এবং শাপলা প্রতীক নতুন করে যুক্ত হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, শাপলা প্রতীক না রাখার আগের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। আর আওয়ামী লীগ যেহেতু নিষিদ্ধ নয়, বরং নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে, তাই প্রতীক বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন, “শাপলা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের সামনে এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে, না হলে আমরা রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করব।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বিরোধ এখন প্রতীক রাজনীতিকে নতুন বিতর্কে ঠেলে দিয়েছে।

একদিকে নৌকা প্রতীক বহাল থাকলেও, অন্যদিকে নিবন্ধন স্থগিত দলের প্রতীক তফসিলে থাকা নিয়ে তৈরি হয়েছে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিরোধ আগামী নির্বাচনের রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ ছড়াতে পারে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার
প্রধান নির্বাচন কমিশনার

এদিকে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৫টি। এই দলগুলোর মার্কা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ২০০৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের বিধিমালার বিধি ৯-এর উপবিধি ১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারিত ১৪০টি প্রতীক থেকে প্রতীক বাছাই করতে পারবে। এই বিধির সংশোধন আনা হয় ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের সংশোধিত বিধিতে ৬৪টি প্রতীক উল্লেখ করা হয়। যেখান থেকে পুরাতন দল ছাড়াও নতুন নিবন্ধিত দল প্রতীক বাছাই করতে পারবে।

সে হিসাবে ৬৪টি প্রতীকের মধ্যে রয়েছে আপেল, কলার ছড়ি, কুড়াল, আম, কাঁঠাল, কুঁড়েঘর, উদীয়মান সূর্য, কাস্তে, কোদাল, একতারা, কুমির, খাট, কবুতর, কুলা, খেজুরগাছ, গরুর গাড়ি, দালান, মাথাল, গাভী, দেয়ালঘড়ি, মিনার, গামছা, ধানের শীষ, মোমবাতি, গোলাপ ফুল, নোঙ্গর, রকেট, ঘণ্টা, নৌকা, রিকশা, চাকা, ফুলকপি, লাঙ্গল, চাবি, ফুলের মালা, শঙ্খ, চেয়ার, বাঘ, সিংহ, ছড়ি, বটগাছ, স্যুটকেস, ছাতা, বাইসাইকেল, হাত (পাঞ্জা), ট্রাক, বাঁশি, হাতঘড়ি, টেলিভিশন, বেঞ্চ, হাতপাখা, ডাব, বেলুন, হাতুড়ি, তবলা, মই, হারিকেন, তারা, মোটরগাড়ি (কার), হুক্কা, তরমুজ, মশাল, দাবাবোর্ড, ট্রাক ও মাছ।

এই প্রতীকগুলো থেকেই ৫৫টি নিবন্ধিত দল পছন্দমতো প্রতীক কিংবা ‘মার্কা’ সংগ্রহ করেছে। প্রতীকের তালিকায় নজর দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে নদী ও কৃষিভিত্তিক প্রতীকের পাশাপাশি ফল, ফুল, পশু-পাখি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী সবই রয়েছে।

মনে করা হয়, নির্বাচন প্রতীক যখন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন আপামর জনসাধারণের কথা ভেবেই নির্ধারিত হয়েছিল। অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষও যাতে চিহ্ন দেখে ভোট দিতে পারে, তার জন্য নেওয়া হয়েছিল এই ব্যবস্থা। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের প্রতীক চেনানোর জন্য পরিশ্রমও করে অনেক বেশি। ব্যানারে-পোস্টারে ছেয়ে ফেলে পুরো এলাকা। কান পাতলেই শোনা যায় ‘…মার্কায় ভোট দিন’ স্লোগান।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/