শিশু হাসপাতাল: ড্যাব সদস্য হলেই নিয়োগ, পদোন্নতি

Reporter Name / ৮ Time View
Update : রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫


বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চিকিৎসক নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে এক তুঘলকি কাণ্ড চলছে। কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই পছন্দমতো ৬৫ জনকে নিয়োগ এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাজনৈতিক বিবেচনায় ২১ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যাদের প্রায় সবাই জাতীয়তাবাদী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর সদস্য।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করায় অন্য হাসপাতালের কেউ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। গত ২৯ জুন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুল হক অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য ৬৫ জন চিকিৎসকের একটি তালিকা তৈরি করেন। এর অনুমোদন দেন হাসপাতালটির পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম আজিজুল হক। তিনি ড্যাবের সাবেক সভাপতি। আর মাহবুবুল হক ড্যাবের সদস্য। এদের বেতন-ভাতার জন্য বছরে প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।

এছাড়াও, বিগত সরকারের সময় বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এমন দাবি তুলে বেশ কয়েকজন জাতীয়তাবাদী ঘরানার চিকিৎসককে পদোন্নতি দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন, ড্যাবের শিশু হাসপাতাল শাখার সভাপতি ডা. আজহারুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পর তাকে পুনরায় পদোন্নতি দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডা. আজহারুল ছয় বছর আগে হাসপাতালের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। নতুনভাবে তাকে হাসপাতালের উপপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যা হাসপাতালের বিধানে নেই!

হাসপাতালের প্রশাসনিক গাইডলাইনে বলা হয়েছে, হাসপাতালে চাকরিরত একজন সহযোগী অধ্যাপক এই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন। হাসপাতালে এই পদের জন্য ভুরি ভুরি যোগ্য চিকিৎসক থাকার পরেও আজহারুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়ায় বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১২-১৪ লাখ টাকা খরচ হবে।

মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ইসরাত জাহান লাকিকেও একই পন্থায় পদোন্নতি দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই চিকিৎসক ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধার আশায় বিগত দিনে অন্য বেসরকারি হাসপাতালে চলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি পুনরায় শিশু হাসপাতালে যোগদান করেন। যেখানে তার পদে পূর্ববর্তী আরও অনেক যোগ্য অধ্যাপক রয়েছেন।

একইভাবে ৫ আগস্টের পর অধ্যাপক নাজমা ও অধ্যাপক আব্বাসকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের কেউই জাতীয় পর্যায়ের কোনো ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন না। এর আগে এরা সবাই শিশু হাসপাতাল থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিদায় নেন। ৫ আগস্টের পর তারাও নিজেদের বঞ্চিত হিসেবে দাবি করেন।

এ ধরনের অন্তত ২১ জন ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক; যারা কিনা ড্যাবের সদস্য—তাদেরকে নিয়মবহির্ভূতভাবে সহকারী এবং সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এসব পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আরও জানা যায়, ডিপ্লোমা ইন চাইল্ড হেলথ (ডিসিএইচ) ডিগ্রিধারী একাধিক ব্যক্তি সহকারী অধ্যাপক হয়ে হাসপাতালে সিন্ডিকেটের প্রভাব বিস্তার করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ডা. রিপন, ডা. মাহমুদুল হক চৌধুরী রানা, ডা. সূচি, ডা. লুনা, ডা. সাজেদা, ডা. নিলুফার, ডা. ফারুকসহ অনেকে। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন ড্যাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ কামাল।

অভিযোগ রয়েছে, ড্যাবের শিশু হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক এম এ কামাল ২০০৪ সালে বিএমএ’র সদস্যপদ পাওয়ার পর ২০২৪ সালেও বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হন। ‘সিলেকশন-১ কমিটির’ সদস্য হিসেবে হাসপাতালের অনেক নিয়োগ ও পদায়ন তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে চলছে।

এছাড়া সহকারী অধ্যাপকের পদ থেকে সরাসরি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ডা. শাহজাহানকে। অথচ বিগত দিনে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সময় সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএমএ’র সাবেক সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সহকারী অধ্যাপকের পদ বাগিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

ডা. শাহজাহানের বিরুদ্ধে হাসপাতালের রোগী কেনাবেচা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. আতিক, যিনি রাজধানীর কাঠালবাগান পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও তেজগাঁওয়ের কিউর হাসপাতালের মালিকানায় রয়েছেন।

এছাড়াও হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যেও সিন্ডিকেটের প্রভাব স্পষ্ট। নান্নু, মোবারক নামের কর্মচারীরা সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বলে অভিযোগ উঠেছে। মোবারকের সাভারে চারতলা একটি বাড়িও রয়েছে। যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এমদাদুল হক শিমুল, ডা. রিপন ও ডা. ফারুক।

অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেট বিভিন্ন আইসিইউ হাসপাতালে রোগী বিক্রি করে থাকেন। রোগী প্রতি ভূইফোঁড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ রোগী পাঠিয়ে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন।

হাসপাতালের উপপরিচালক (অর্থ)–এর দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ নেসার উদ্দিন সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য। শিশু হাসপাতালের এক আতঙ্কেও নাম। বিভিন্ন ভুয়া বিল-ভাউচার করে বিল তোলার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন খোদ হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম আজিজুল হক। যিনি ড্যাবের সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি তাকে ওই হাসপাতালের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

বিশেষায়িত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে চিকিৎসক হিসেবে সুনামধন্য কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এ কে এম আজিজুল হক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ‘ডিপ্লোমা ইন অ্যানেসথেসিওলজি (ডি.এ.)’ পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি অন্য কোনো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেননি।

তবে সক্রিয় পেশাজীবী রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় তিনি সারাদেশে চিকিৎসকদের মাঝে বেশ পরিচিত। তিনি এর আগে ড্যাবের সভাপতি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ বা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে এসব যোগ্যতা শিশু হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন ওই হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা একাধিক প্রশাসনিক ব্যক্তি।

চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজের জন্য অফিস কক্ষ নির্মাণ করেন এই চিকিৎসক। এছাড়া নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে হাসপাতালের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এসব নিয়োগ, পদোন্নতি ও দুর্নীতি বাস্তবায়নে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন হাসপাতালটির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নতুনদের জায়গা করে দিতে ইতোমধ্যে হাসপাতালটির বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কিংবা দায়িত্ব ছাড়াই বসিয়ে রাখা হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়; হাসপাতালটির দুটি কক্ষ নিজেদের দখলে নিয়েছে ড্যাব। যেখানে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।

রাজধানীর শ্যামলিতে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট সারাদেশে শিশুদের একমাত্র বিশেষায়িত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অন্যান্য বেসরকারি যেসব শিশু হাসপাতাল রয়েছে সেখানে চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি হওয়ায় প্রতিদিন সারাদেশ থেকে শিশুদের নিয়ে এই হাসপাতালের শরণাপন্ন হন সাধারণ মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল শিশুদের জটিল চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। আর এ কারণে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞমানের এফসিপিএস, এমডি, এমএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টোটা!

এদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই চিকিৎসক নিয়োগের ঘটনায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন বঞ্চিতরা।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই ধরনের অনিয়ম ও প্রভাব-ব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে ‘শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার’ মূল লক্ষ্য আর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম আজিজুল হক বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেন, নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত চলছে। আর পদোন্নতি যাদের দেওয়া হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই বিগত দিনে বঞ্চনার শিকার। ৫ আগস্টের পর প্রশাসনের অনেক জায়গায় এ ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/