ঢাকার একটি পাইকারি বাজারে আমের বাহার দেখে বোঝা মুশকিল, এই ফল শুধু খাওয়ার জন্যই নয়—এশিয়ার রাজনীতি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আর ভূরাজনৈতিক উত্তাপের মাঝেও তা হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ এক কূটনৈতিক অস্ত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঠিকানায় যে এক হাজার কেজি হাড়িভাঙা আম পাঠিয়েছেন, তা ঘিরেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে “আম কূটনীতি”। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এই ফল উপহারকে দ্বিপাক্ষিক টানাপড়েনের মাঝে ‘মিষ্টতার বার্তা’ বলেই দেখছে।
নরেন্দ্র মোদীর আমপ্রেম নতুন কিছু নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় গ্রামের বাগান থেকে পাকা আম পেড়ে খাওয়ার স্মৃতি আজও তাঁর কাছে অমূল্য। সেই সূত্র ধরেই শেখ হাসিনা প্রতি বছর ভারতের নেতাদের উদ্দেশে আম পাঠাতেন। শুধু দিল্লি নয়—পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা কিংবা এমনকি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও শেখ হাসিনার এই আম-উপহারের তালিকায় ছিলেন।
এই বছর সেই রীতি অব্যাহত রেখেছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী প্রশাসন। অনেকের কাছে তা ছিল অপ্রত্যাশিত, কারণ শেখ হাসিনা ও ড. ইউনূসের রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকার মনে করেন, বাংলাদেশ বর্তমানে আমেরিকান চাপ, মিয়ানমার সংকট ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতায় এমনভাবে চাপে আছে যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে আমের মাধ্যমে কূটনৈতিক বার্তা পাঠানোই ছিল বাস্তবতা।
ইতিহাসে ‘আম’ কূটনীতি
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই দীর্ঘদিন ধরে আমকে তাদের কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। পন্ডিত নেহরু থেকে শুরু করে রাজীব গান্ধী পর্যন্ত—বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের হাতে আমের ঝুড়ি তুলে দেওয়ার রেওয়াজ চালু রেখেছেন ভারতীয় নেতারা।
১৯৫৫ সালে নেহরু চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে উপহার দিয়েছিলেন দশেরি ও ল্যাংড়া আমের চারা। আবার সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভের জন্যও গিয়েছিল মালিহাবাদের আম। রাজীব গান্ধী ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনোকে আম উপহার দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানও এই রীতিতে পিছিয়ে নেই। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের নেতা মাও সেতুংকে উপহার দিয়েছিলেন এক বাক্স আম, যা পরবর্তীতে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত হয়। শ্রমিক ও ছাত্ররা কাঁচের পাত্রে সেই আম রেখে তাকে ‘চেয়ারম্যানের উপহার’ হিসেবে পূজা করতো।
১৯৮১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘আনোয়ার রাতাওল’ প্রজাতির আম উপহার দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে নওয়াজ শরিফ মোদী, প্রণব মুখার্জি ও সোনিয়া গান্ধীকেও পাঠিয়েছিলেন আমের ঝুড়ি।
‘আম’ ও জিয়া উল-হকের মৃত্যুর রহস্য
দক্ষিণ এশিয়ার আম ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত অংশগুলোর একটি হলো জেনারেল জিয়া উল-হকের বিমান দুর্ঘটনা। ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট ‘পাক ওয়ান’ নামে পরিচিত সি-১৩০ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানে ছিলেন জিয়া, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত, ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
এই দুর্ঘটনার সঙ্গে রহস্যময়ভাবে জড়িত ছিল কিছু আমের বাক্স—যা উপহার হিসেবে বিমানে ওঠানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানি লেখক মোহামেদ হানিফ লিখেছেন বেস্টসেলার উপন্যাস “A Case of Exploding Mangoes”, যেখানে কল্পনা ও সত্যি মিশে উঠে এসেছে এক গভীর রাজনৈতিক স্যাটায়ার।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমের ভূমিকা
বিশ্বের বৃহত্তম আম রফতানিকারক দেশ ভারত, এরপর মেক্সিকো ও পাকিস্তান। বাংলাদেশও প্রথম দশে রয়েছে। তবে রফতানিতে পাকিস্তান ভারতের চেয়েও বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে মত দিয়েছেন গবেষক জাহিদ শাহাব আহমেদ ও মহম্মদ জাহানজাইব।
পাকিস্তান নিয়মিত আম উৎসব ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আম খাইয়ে বিদেশি নেতাদের মন জয় করার চেষ্টা তাদের রপ্তানিতে সফলতা এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপে পাকিস্তানি আমের জনপ্রিয়তা ভারতের চেয়ে বেশি।
ভারতীয় আমের রফতানি কম হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আঁশ বা ফাইবার। ভারতের বেশির ভাগ আম দ্রুত পচনশীল, ফলে ‘শেলফ লাইফ’ কম। অন্যদিকে, পাকিস্তানি আম যেমন ‘সিন্ধরি’, ‘চৌসা’ বা ‘আনোয়ার রাতাওল’ তুলনামূলক বেশি দিন তাজা থাকে।
‘ম্যাঙ্গো ইনিশিয়েটিভ’ ও মার্কিন বাজার
২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ভারত সফরে এসে আম খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। পরের বছর যখন নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে ভারতীয় আমের প্রথম চালান পৌঁছায়, নিউ ইয়ক টাইমস তা ব্যাখ্যা করেছিল “সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ফল” হিসেবে।
এদিকে ইসলামাবাদে পাকিস্তানি দূতাবাসে ‘ম্যাঙ্গো পার্টি’ আয়োজন আর মার্কিন নেতাদের আম উপহার দিয়ে পাকিস্তানও তাদের আমকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরেছে কৌশলে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আম শুধুই ফল নয়। কখনও কূটনৈতিক বার্তা, কখনও বন্ধুত্বের প্রতীক, আবার কখনও ষড়যন্ত্রের অংশ—এই ফল ঘিরে গল্পের শেষ নেই। ঢাকার পাইকারি বাজারের এক ঝুড়ি আম হয়তো আজ দিল্লি পৌঁছেছে। কিন্তু তার ভেতরে কতটা মিষ্টি, আর কতটা বারুদের ঘ্রাণ, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর।
যেমন মোহামেদ হানিফ বলেছিলেন, “আমার বই আবার পড়ুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।” এই অঞ্চলে “আম কখনোই শুধু আম নয়” — বরং কূটনীতির এক ‘খাস’ মাধ্যম।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
https://slotbet.online/