টেকনাফে থামছে না মাদক ব্যবসা, উল্টো বাড়ছে

Reporter Name / ১ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫


কক্সবাজার জেলায় ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথের প্রথম চালান ধরা পড়েছিল ২০২১ সালে। এরপর থেকে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আইসের চালান আসা থামেনি, বরং বেড়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথে বেড়েছে ইয়াবা আসার পরিমাণ। গত আট মাসে ৩৬ লাখের বেশি ইয়াবা উদ্ধার ও ৪২ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন ধরা পড়ার ভয়ে মাদক পাচারের জন্য সাগরপথে নতুন রুট ব্যবহার করছে কারবারিরা। এজন্য মূলহোতারা আগের মতো ধরা পড়ছে না।

টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদ। ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। সেখানে গড়ে উঠেছে ইয়াবা তৈরির ছোট-বড় অনেক কারখানা। সেখান থেকে বাংলাদেশে আসছে মাদকের চালান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, নাফ নদ পেরিয়ে আগে শুধু ইয়াবা এলেও এখন পাল্লা দিয়ে আইসের চালান আসা বাড়ছে। বিভিন্ন সময় অভিযানে মাদকের বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা ও মাদক কারবারিদের পৃষ্ঠপোষকরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে থামছে না মাদক ব্যবসা, বরং বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পলাতক মাদক কারবারিরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চেষ্টা করছে মাদকের বড় বড় চালান দেশে আনার জন্য। পাশাপাশি কোনও কোনও মাদক কারবারি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের মদতে বড় বড় চালান আসছে মাদকের। এ অবস্থায় নাফ নদে কোস্টগার্ড ও বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। এতে করে পাচারের রুট পরিবর্তন করে নৌপথ ব্যবহার করছে কারবারিরা। সম্প্রতি সাগরপথে পাচারের সময় কক্সবাজারসহ বঙ্গোপসাগর উপকূলে বড় বড় চালান ধরাও পড়েছে।

র‌্যাব ও বিজিবির দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টেকনাফ সীমান্ত ও উপকূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে মাদক আনার রুট পরিবর্তন করেছে পাচারকারীরা। সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পাশাপাশি মাছ ধরার ট্রলারে করে ইয়াবা আনা হচ্ছে। বিশেষ করে ইয়াবার বড় চালান মিয়ানমার থেকে নৌপথে এনে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বাংলাদেশের জলসীমানার বাইরে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল থাকে না। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে মাদকের চালান সমুদ্রপথে কক্সবাজার, টেকনাফ, বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা ও চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে কারবারিরা। এমন পাচার ঠেকাতে সমুদ্রপথে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশিচৌকি বসানোর প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই দুই কর্মকর্তা।

সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট নৌপথে আনার সময় কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মোহনায় অভিযান চালিয়ে চার লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ ৯ জনকে আটক করে র‌্যাব-১৫। এ সময় পাচারকাজে ব্যবহৃত ট্রলারও জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর সহকারী পুলিশ সুপার আ. ম. ফারুক।

তিনি বলেন, ‘নৌপথে মাদক পাচার বেড়েছে। পাচার ঠেকাতে সীমান্ত ও নাফ নদে নজরদারি এবং অভিযান কার্যক্রম বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর ফলে পাচারের রুট পরিবর্তন করে নতুন নৌপথ ব্যবহার করছে কারবারিরা। আগে পাচারের জন্য টেকনাফ সীমান্ত বেশি ব্যবহার করলেও এখন কক্সবাজার, বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা ও চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে তারা।’

টেকনাফ বিজিবি সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের উপকূল থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নৌযান দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে বঙ্গোপসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমানা অতিক্রম করে মাদকের বড় চালান পাচার অব্যাহত রেখেছে কারবারিরা। আন্তর্জাতিক জলসীমানা এলাকায় নজরদারি না থাকায় সেখান থেকে মাদকের চালান এনে বাংলাদেশের উপকূলের বিভিন্ন নির্জন পয়েন্ট দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে তারা।

বিজিবি জানায়, টেকনাফ সীমান্ত ও নাফ নদ দিয়ে পাচারের সময় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত (আট মাস) বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। এগুলোর বাজারমূল্য ১০৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১২ লাখ ৪৭ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে ৯ লাখ ১৩ হাজার ৩৭৫ পিস, মার্চে সাড়ে তিন লাখ, এপ্রিলে এক লাখ ১১ হাজার ৮২০ পিস, মে মাসে এক লাখ ২০ হাজার, জুনে চার লাখ ৮৪ হাজার, জুলাইয়ে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫ পিস এবং আগস্টে এক লাখ ৭৯ হাজার ১৫৩ পিস উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ৪২ জন পাচারকারীকে আটক করে ৫৯টি মামলা করা হয়েছে। উদ্ধার মাদকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগের তুলনায় আটকের ঘটনা কমেছে। এর মানে পাচার কমেনি, বরং বেড়েছে। তবে নৌপথে নতুন রুট ব্যবহার করায় ধরা পড়ছে কম।

সমুদ্রপথে আগের চেয়ে মাদক পাচার বেড়েছে এবং কারবারিরা নতুন রুট ব্যবহার করছে বলে জানালেন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘টেকনাফ সীমান্ত ও নাফ নদ দিয়ে আমাদের বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে কারবারিরা মাদক ও চোরাচালানের জন্য বিকল্প হিসেবে নতুন রুট ব্যবহার করছে। সমুদ্রপথে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে তারা।’

আশিকুর রহমান আরও বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু নতুন নতুন পথে পাচারের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আন্তর্জাতিক জলসীমানা এলাকায় নজরদারি না থাকায় সেটিকে কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা। পাচারকাজে নতুন নতুন লোক যুক্ত হচ্ছে। তবে মাদক ঠেকাতে আমরা নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পুনর্মূল্যায়ন করে এবং চোরাচালান প্রতিরোধ করতে কার্যকরী অভিযান পরিচালনা করছি।’

টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, টেকনাফ পর্যটনশিল্পে এগিয়ে গেছে। তবে মাদক ও চোরাচালানের কারণে পিছিয়ে পড়ছে এই খাত। মিয়ানমার থেকে বেশিরভাগ মাদকের বড় চালান নৌপথে মাছ ধরার ট্রলারে করে বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন নির্জন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে। এজন্য আগের মতো ধরা পড়ছে না।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এইচ. এম. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদকবিরোধী অভিযানে গতি না থাকায় আত্মগোপনে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এলাকায় ফিরে নিজের লোকজন দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন নৌপথে বেড়েছে পাচার। তাই খুব দ্রুত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান চালাতে হবে। না হলে এই মরণনেশা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

সীমান্তে সব ধরনের অপতৎপরতা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মাদক পাচার ঠেকাতে কঠোর নজরদারি চলছে। শুধু নাফ নদ নিয়ে ভাবলে চলবে না। কারণ আমাদের বিস্তীর্ণ সাগর ও উপকূলের পথ দিয়ে ইয়াবা ও আইসের বড় চালানগুলো ঢুকে পড়ছে। এর প্রধান কারণ সেখানে তেমন একটা টহল নেই। তাই আমরা সরকারকে বলেছি এসব জায়গায় টহল ও নজরদারি যেন বাড়ানো হয়।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা সীমান্তের ওপারে ২৭০ কিলোমিটার এলাকা এখন আরাকান আর্মির দখলে। তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন যোগাযোগ নেই। ফলে সেখান থেকে আসা মাদকের বিষয়ে তেমন একটা কিছু বলাও যাচ্ছে না। তবে মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় আমরা সেদেশের কোন জায়গাগুলোতে ইয়াবার কারখানা রয়েছে, কীভাবে পাচার হচ্ছে; সে তথ্যগুলো তাদের জানিয়েছিলাম। তখন তারাও ব্যবস্থা নিত, আমরাও নিতাম। এজন্য পাচার কিছুটা কম হতো। এখন সে সুযোগ নেই। তবু মাদক ও চোরাচালান রোধে সীমান্তের পাশাপাশি নাফ নদে টহল জোরদার রয়েছে বিজিবির।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/