দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা লাংলোক; যেভাবে যাবেন

Reporter Name / ১ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান। পাহাড়-ঝরনা, নদী-ঝিল, সবুজ বনভূমি আর আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য এই জেলা দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতিপ্রেমী এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঝর্ণা, যেগুলো তাদের অনন্য সৌন্দর্যের জন্য পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। প্রতিটি ঝর্ণার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও কাহিনি। এর মধ্যে অন্যতম হলো লাংলোক ঝর্ণা, যা দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা হিসেবে পরিচিত।

 

লাংলোক ঝরনার পরিচয় ও নামের উৎস

অ্যাডভেঞ্চার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, লাংলোক ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ৩৮৯ ফুট। স্থানীয় খুমি ভাষায় ‘লাংলোক’ মানে বাদুড়ের ঝর্ণা। নামটির পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ কারণ। ঝর্ণার কাছে রয়েছে একটি গুহা, যেখানে বহু বাদুড়ের বসবাস। এই বাদুড়ের কারণে ঝর্ণার নাম হয়েছে লাংলোক।

সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা

লাংলোক ঝর্ণার সৌন্দর্য মূলত বর্ষায় পূর্ণতা পায়। এই সময় ঝর্ণাটি যেন পাহাড়ের বুকে মিলিয়ে যাওয়া এক সাদা রেশমি চাদরের মতো নেমে আসে। শীতকালে বা গ্রীষ্মে পানির প্রবাহ কমে গেলেও বর্ষার দিনে ঝরনাটি তার আসল রূপে সজ্জিত হয়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন ঝরনার কলকল ধ্বনি কানে আসে, তখন শরীরের ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।

ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে শোনা যায় পাখির ডাক, পাতার মর্মর শব্দ, আর ঝরনার গর্জন—যেন প্রকৃতি নিজ হাতে তৈরি করেছে এক সিম্ফনি। পর্যটকরা এখানে এসে ঝরনার জলে গা ভেজাতে ভুল করেন না। দূর থেকে যেমন মনোমুগ্ধকর, কাছে গিয়ে তেমনি রোমাঞ্চকর।

ঝরনার পথে রোমাঞ্চকর যাত্রা

লাংলোক ঝরনায় পৌঁছাতে হলে আগে যেতে হবে থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নে। তিন্দু বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় ২০ মিনিট নদীপথ পাড়ি দিলেই পৌঁছানো যায় সাঙ্গু নদীর ঘাটে। সেখান থেকে শুরু হয় আসল অ্যাডভেঞ্চার। খাড়া পাহাড়ি পথ, পাথুরে ঢাল, ঘন জঙ্গল আর আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু ট্রেইল পার হতে হয়। একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই সতর্কতা জরুরি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঝরনার কাছে পৌঁছাতে অভিজ্ঞ ট্রেকারদের সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট, কিন্তু নতুনদের ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। ট্রেকিংয়ের প্রতিটি ধাপে রয়েছে রোমাঞ্চ। দূর থেকে ঝরনাকে যত সুন্দর মনে হয়, কাছে গেলে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি উপভোগ্য মনে হয়।

স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ও পর্যটকের মতামত

পাও খুমি পাড়ার বাসিন্দা পাওরিং খুমি ও নৌকার মাঝি সাওচিং জানান, আগে ঝরনাটি তেমন পরিচিত ছিল না। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। এখন অনেকেই এখানে আসছেন, তবে পথের ঝুঁকি বিবেচনায় সবাইকে গাইড নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

অন্যদিকে পর্যটক মাহমুদ, সাব্বির ও সুজানা বলেন, তারা ঝরনার কথা জেনেছেন বন্ধুদের মাধ্যমে। বাস্তবে এসে ঝরনার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের ভাষায়, “পাহাড়ি পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় লাংলোকের অপরূপ সৌন্দর্য।”

ঢাকা থেকে লাংলোক ঝরনায় যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে বান্দরবান শহরে। গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং ফকিরাপুল থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে সোহাগ, শ্যামলী, হানিফ, এস. আলম, সেনা পরিবহনসহ বিভিন্ন বাস ছাড়ে।

বাস ভাড়া:

  • নন-এসি: ৯৫০-১,১০০ টাকা
  • এসি: ১,৬০০-২,২০০ টাকা
    সময় লাগবে প্রায় ৮-৯ ঘণ্টা

বান্দরবান থেকে থানচি যেতে হবে স্থানীয় পরিবহন যেমন চাঁদের গাড়ি (জিপ) বা মোটরবাইকে।

  • চাঁদের গাড়ি ভাড়া: ৭,০০০-৯,০০০ টাকা (রিটার্নসহ, ৬-৮ জনের জন্য)
  • মোটরবাইক ভাড়া: প্রতি বাইক ১,৫০০-২,০০০ টাকা

থানচি থেকে তিন্দুতে নৌকায় যেতে হবে।

  • নৌকা ভাড়া: ২,০০০-৩,০০০ টাকা (দুই পথে, শেয়ার করলে খরচ কমবে)

ঝরনার পথে যেতে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক।

  • গাইড ভাড়া: ৫০০-৮০০ টাকা

খরচের হিসাব

ঢাকা থেকে লাংলোক ঝরনা ভ্রমণের আনুমানিক খরচ:

  • বাস ভাড়া (দুই পথে): ১,৯০০ টাকা
  • বান্দরবান থেকে থানচি: ১,২০০-১,৫০০ টাকা (শেয়ার)
  • নৌকা ভাড়া: ৫০০-৮০০ টাকা (শেয়ার)
  • গাইড: ৫০০ টাকা
  • খাবার: ৮০০-১,০০০ টাকা
  • অন্যান্য খরচ: ২০০-৩০০ টাকা

মোট খরচ: আনুমানিক ৪,৫০০-৫,৫০০ টাকা (প্রতি জন)

থাকার ব্যবস্থা

বান্দরবান শহরে হোটেল হিল ভিউ, গ্রিন প্যারাডাইস, হোটেল বান্দরবান হিল রিসোর্টসহ বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল রয়েছে।

  • ভাড়া: ১,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকা প্রতি রাত।
    থানচিতেও স্থানীয়ভাবে কটেজ ও হোমস্টে পাওয়া যায়।

ভ্রমণ টিপস

✅ বর্ষাকাল বা শরৎকাল লাংলোক ঝরনা ভ্রমণের সেরা সময়।
✅ হালকা ব্যাগ, গ্রিপওয়ালা জুতা, রেইনকোট এবং পানির বোতল সঙ্গে নিন।
✅ গাইড ছাড়া জঙ্গলে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
✅ স্থানীয় সংস্কৃতি ও নিয়ম মেনে চলুন।

শেষ কথা

লাংলোক ঝরনা শুধু একটি ঝরনা নয়, এটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর শিল্পকর্ম। পাহাড়ি সৌন্দর্য, সাঙ্গু নদীর নীল জল, ঝুঁকিপূর্ণ রোমাঞ্চকর পথ—সবকিছু মিলিয়ে লাংলোক ঝরনা পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যারা শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির কাছে সময় কাটাতে চান, তাদের জন্য এটি হতে পারে স্বপ্নের গন্তব্য।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/