২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন কৌশল প্রণয়ন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষ করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; পূর্ববর্তী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কোনো কর্মকর্তাকে এবার আর দায়িত্ব না দেওয়া, দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়াই সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো, নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন নিশ্চিত করতে ৩১ ডিসেম্বর ডেডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সদস্য নিয়োগ ও পাসিং আউট কার্যক্রমও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া অস্ত্র উদ্ধার সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আগে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম সাধারণত অস্ত্রনির্ভর হয়ে থাকে। যেহেতু এখনো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বেহাত রয়েছে এবং সেগুলো উদ্ধার না হলে সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সরকার গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বেশ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা করে সেগুলো বিশেষ নজরদারির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকেও অবহিত করা হয়েছে এবং একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টার স্থাপন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া জেলাপর্যায়ও রাখা হচ্ছে মনিটরিং ব্যবস্থা।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের আসন্ন নির্বাচনে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এর আগে গত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে নির্বাচনের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সভায় এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও পুলিশ অধিদপ্তরকে কাজ করতে বলা হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) নজরদারি বাড়ানো ও সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি এবং বিজিবিকেও সহায়তা করতে বলা হয়েছে।
সভায় আরও বলা হয়, নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন সময়ে সব সংস্থাকে একসঙ্গে এবং নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব নির্বাচনী প্রস্তুতি শেষ করার লক্ষ্যে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়া চালাচ্ছে। এই মহড়ার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য সংঘাত পর্যালোচনা, পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসার-কোস্ট গার্ডের সমন্বয় পরিকল্পনা, মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স ও টহল দলের কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আচরণবিধি ও অস্ত্র ব্যবহারবিষয়ক নির্দেশনা দেওয়া হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে কার কাছে রিপোর্ট করতে হবে এবং দ্রুত ব্যবস্থা কীভাবে নেওয়া হবে তারও কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে।
সভা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ‘ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান চালানো হলেও লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের বড় অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি।
গত বছর আগস্টে ৪৬০টি থানায় হামলায় লুট হয়েছিল পাঁচ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র এবং ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে চার হাজার ৩৯০টি অস্ত্র ও তিন লাখ ৯৪ হাজার ১১২ রাউন্ড গুলি। ফলে এখনো এক হাজার ৩৬৩টি অস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ রাউন্ড গুলি বেহাত রয়েছে। এ অবস্থায় অস্ত্র উদ্ধারে তথ্যদাতাদের জন্য সরকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, সরকারের রোডম্যাপ ইতিবাচক উদ্যোগ হলেও মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি, নইলে ভোটারদের আস্থার সংকট কাটবে না।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গোয়েন্দা তথ্যনির্ভর অভিযান, স্থানীয় তথ্যদাতা সক্রিয় করা ও সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে না পারলে সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাও জরুরি।”
https://slotbet.online/