স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ
(Google News) ফিডটি
খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারে বিপর্যস্ত দেশের ব্যাংকখাত। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। কৌশলে করায় পাচার করা অর্থ ফেরাতে দেখা দিচ্ছে নানান জটিলতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ঋণের বিপরীতে দেশে থাকা সম্পদ বিক্রি করে টাকা উদ্ধারের ঘোষণা দিলেও সে কার্যক্রমেও নেই গতি।
সূত্র জানায়, ভুয়া ঋণ অনুমোদন আর নামহীন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে লোন পাস করার ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে তাদের যে সম্পদ দেশে রয়েছে তা অতি সামান্য। এসব সম্পদ বিক্রি করে খুব বেশি লাভ হবে না। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর কাজটিও বেশ জটিল। ফেরত আনার হারও কম। তবুও হাল না ছাড়ার পরামর্শ খাত সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে বিতরণ করা ঋণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, পাঁচ ব্যাংকের কাছেই মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি টাকা। এতে ওইসব ব্যাংকের মূলধন কমে গেছে। পাশাপাশি আয় তলানিতে নেমেছে, বেড়েছে আর্থিক ঘাটতি। প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ১৬টি ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকখাতের মোট মূলধনের অনুপাত (এআরএআর) ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এই হার ১০ শতাংশের বেশি থাকতে হবে। গত বছরের জুন পর্যন্ত এ অনুপাত ছিল ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা অনেকটা কমেছে।
খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও নাজুক। পারছে ঋণ বিতরণ করতে, ফেরত দিতে পারছে না আমানতকারীর টাকা। তবে আমানতকারীর টাকা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতকারীদের উদ্দেশ্যে গভর্নরের বক্তব্য, দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়বে। আগে খেলাপির তথ্য লুকানো ছিল সেগুলো এখন বের হচ্ছে। ব্যাংকের অবস্থা যাই হোক আমানতকারীদের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারবো। বড় ঋণ খেলাপিদের দ্রুত চিহ্নিত করে দেশে তাদের সম্পদ বিক্রি করে টাকা উদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সে উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় খেলাপিদের দ্রুত চিহ্নিত করে দেশের অভ্যন্তরে তাদের যত সম্পদ রয়েছে তা উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে। প্রথমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে টাকা উদ্ধার, পরে বাইরে থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।
বিভিন্নভাবে নামহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদন করে সেসব টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। অন্যদিকে সেই ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় পরিণত হয়েছে খেলাপিতে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে উদ্যোগ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ভালো কিছু আশা করা যায়। তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের কোনো এক মন্ত্রীকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাদের দেশে লুটপাট নেই, তাহলে কীভাবে এস আলম বাংলাদেশ থেকে সেখানে অর্থপাচার করে? উত্তরে তারা বলেছিল টাকা সিঙ্গাপুরে প্রবেশের প্রক্রিয়াটা জটিল ছিল। সাইপ্রাস থেকে সে দেশে টাকা ঢুকেছে, যেটা বৈধ ছিল। তাহলে তাকে কীভাবে ধরা যাবে। সে দেশের আইনও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। এ ধরনের সমস্যা আছে, আবার আমাদের চেষ্টাও চলছে। খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আগে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতো না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ঋণ খেলাপির সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপি ও প্রভিশন ঘাটতি বেশি। তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে তেমন কোনো ব্যবসা করেনি ব্যাংক, ফলে প্রভিশনে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দেশের সম্পদ ও বাইরে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতে কাজ চলমান। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিকভাবে আইনজীবী নিয়োগ হয়েছে। আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি। খেলাপি ঋণ এবং অর্থপাচার নিয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের সাহায্য করতে খেলাপি ঋণ গোপন করা হতো। এখন সেই প্রথা বন্ধ, প্রকাশ করা হচ্ছে লুকিয়ে রাখা তথ্য। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ব্যাংকখাত থেকে খেলাপি নামক সমস্যার সমাধান করা না গেলে আমানতকারীদের আস্থা থাকবে না। তাদের আস্থা ফেরাতে হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনা বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যে দেশে টাকা আছে সে দেশের সরকার যদি সহযোগিতা করে তাহলে টাকা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা যদি সহযোগিতা না করে বা না করতে চায় তাহলে টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন। দেশে সম্পদ নেই পাচারের বিপরীতে। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের চেয়ে দেশেরটা উদ্ধার সহজ। তবে হাল ছাড়া যাবে না। টাকা পাচার হওয়া দেশগুলোর সরকারের সহযোগিতা পেলে পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করা যাবে। জব্দ করতে পারলে একটা সংকেত যায় যে এসব (অর্থপাচার) করে নিজেরা লাভবান হতে পারবে না, এতে ভবিষ্যতে নিরুৎসাহিত হবেন তারা।
https://slotbet.online/