অপরাধির অভয়ারণ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান – দৈনিক গনমুক্তি

Reporter Name / ২ Time View
Update : বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫


ঢাবি শিক্ষার্থী হত্যা, মাদক সেবন ও বিক্রয়


হালিম মোহাম্মদ

  • আপডেট সময় :
    ০৩:০৫:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫




    ১৭

    বার পড়া হয়েছে

দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ
(Google News)
ফিডটি

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাদক সেবী ও খুনিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। উদ্যানে মাদক বিক্রি, মাদক সেবন, ছিনতাই, খুন, অসামাজিক কার্যকলাপ, মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনা অহরহ ঘটছে। নারীর শ্লীলতাহানির বিষয়টি ভুক্তভোগীরা লোক লজ্জার ভয়ে তারা চান না যে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অন্য কেউ জানুক। এ কারণে তারা পুলিশের কাছে যেতে চান না। ফলে অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হওয়া উদ্যানটি দিন দিন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চক্র এসব নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বহিরাগত যুগলদের অনেকে উদ্যানে ঘুরতে এসে চক্রের সদস্যদের হাতে ছিনতাই, মারধর ও শ্লীলতাহানি ও খুনের শিকার হন। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কালি মন্দিরের অদুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য (২৫) দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাত ও মারধরে নিহত হয়েছেন। নিহত শাহরিয়ার ছাত্রদলকর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।
প্রাথমিকভাবে জানা যায়, সাম্য স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানা এলাকায়। নিহতের সহপাঠীদের ভাষ্যমতে, টিএসসি সংলগ্ন মন্দিরের গেটে বহিরাগতদের সাথে সংঘর্ষ বাধে তার। এ সময় কেউ সাম্যকে গুরুতর যখম করে পালিয়ে যায়। তার মরদেহ ঢামেকের ইমার্জেন্সি বিভাগের করিডোরে রয়েছে।
সহপাঠীরা আরও জানান, রাত আনুমানিক ১২টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চের পাশ দিয়ে বাইকে যাওয়ার সময় ভিকটিমের বাইক আরেকটি বাইকে লাগে। এ সময় উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ভিকটিমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ডান রানে আঘাত করে। এতে গুরুতর অবস্থায় তাকে ১২টা ১৫ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে রাখা হয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত আহত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা বন্ধু জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে কথা কাটাকাটির জেরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। মরদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে।
এরআগে মাদক নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক মাদক ব্যবসায়ী ও তাঁর সহযোগীদের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। মাদক নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক মাদক ব্যবসায়ী ও তাঁর সহযোগীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এই সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত পাঁচজনের মাথা ফেটেছে।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র আকতারুল করিম ওরফে রুবেল ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় মাদকের নেটওয়ার্কের প্রধান পারুলী আক্তারের মধ্যে বাগ্‌বিত-া থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত। পরে তাঁদের সহযোগীরাও সংঘর্ষে যোগ দেন। প্রথমে আকতারুল পারুলীকে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল দিয়ে আঘাত করেন। এর জেরে পারুলীর সহযোগীরা ইটপাটকেল নিয়ে আকতারুল ও তাঁর সহযোগীদের দিকে তেড়ে যান।
পারুলীর সহযোগী দুই ছিন্নমূল তরুণী বলেন, আকতারুল করিম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসা এক ব্যক্তিকে মাদকসেবী আখ্যা দিয়ে জেরা করছিলেন। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তির পকেটে গাঁজা আছে, এমন অভিযোগ তুলে তাঁকে মারধর শুরু করেন আকতারুল। ঘটনাটি দেখতে পেয়ে পারুলী তাঁদের কাছে যান।
আকতারুলকে পারুলী বলেন, আপনারা ছাত্ররা যখন যা চান, তা কি আমরা দিই না? লোকটাকে মারছেন কেন? এরপর আকতারুলের সঙ্গে পারুলীর কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। জানতে চাইলে পারুলী দাবি করেন, ‘বিনা কারণে’ ইটের আঘাতে তাঁর মাথা ফাটিয়েছেন আকতারুল। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আকতারুল বলেন, ‘পারুলী আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
জানা যায়, ২৬ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেকসংলগ্ন কংক্রিটের বেঞ্চে বসা যুগলদের একে একে জেরা করেন ঢাবির ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এ সময় কয়েক যুগলকে তারা মারধরও করেন। তাদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিন রমনা কালীমন্দিরসংলগ্ন ভাবনগর সাধুসঙ্গ এলাকায় বহিরাগত কয়েক তরুণকে জিম্মি করা হয়। একপর্যায়ে তাদের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
এর পরদিন উদ্যানের শিখা চিরন্তনের পেছনের সড়কে দুই ব্যক্তিকে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী চক্র। এর আগে ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা হয়। মামলার দুই দিন পর গ্রেপ্তার হন ঢাবির কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসম্পাদক রাহুল রায়। এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার একই কর্মকা-ে সক্রিয় হন তারা।
সর্বশেষ ১১ মে বাইক কিনতে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিনতাইয়ের শিকার হন জোবায়ের হোসেন নামে এক যুবক। এ ঘটনায় তিনি ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। পরের দিন পুলিশ ঘটনায় জড়িত কেন্দ্রীয় একই দলের সাবেক সহসম্পাদক নুর উদ্দীনকে এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মুনতাসীর শুভকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার দুজন ভুক্তভোগী যুবককে মারধর করে তার কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। তবে এটিই শেষ নয়, এর আগেও বান্ধবীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া উদ্যানে ছিনতাই, মাদক বিক্রি ও সেবন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা উদ্যানে মাদক বিক্রি ও সেবন করা হচ্ছে। উদ্যানে মাদক সহজলভ্য হওয়ায় বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেকেই এখানে মাদক সেবনের জন্য আসেন। তারা জটলা হয়ে পুরো উদ্যানজুড়ে মাদক সেবন করেন। মুক্তমঞ্চে সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত মাদকের হাট বসে। সেখানে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষকে মাদক সেবন করতে দেখা গেছে। চারুকলার গেট থেকে টিএসসি পর্যন্ত উদ্যানের পশ্চিম পাশে দলবদ্ধ হয়ে কেউ আড্ডায় দাঁড়িয়ে, আবার কেউবা গানের তালে তালে গাঁজা সেবন করছে। কিছু গ্রুপ জুয়া খেলছে। পূর্ব পাশের শিখা চিরন্তন, গ্লাস টাওয়ারের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে এবং কালীমন্দিরের উত্তর পাশে পামগাছের নিচে জটলা বেঁধেও মাদক সেবন করতে দেখা গেছে। বলা চলে, পুরো উদ্যান মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কেননা, ওখানে হাত বাড়ালেই মাদক মিলছে।
টিএসসির গেট দিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করে বাম দিক যেতেই ছাউনির নিচে বিক্রি হচ্ছে মাদক। মালতি নামের এক মাদক স¤্রাজ্ঞী উদ্যানে মাদক বিক্রির নেতৃত্ব দেয়। তার অন্তত ৩০ জন তরুণ-তরুণী হেঁটে হেঁটে উদ্যানে মাদক বিক্রি করছে। আর মালতি রাজ-রানীদের মতো ছাউনির নিচে পায়ে পা তুলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। উদ্যানের দায়িত্বে থাকা পুলিশ, আনসার সদস্যদের চোখের সামনেই এসব ঘটনা ঘটছে। তবুও নির্বিকার তারা।
মন্দিরের পূর্ব পাশের ঝোপঝাড়ে এবং গ্লাস টাওয়ারের পূর্ব পাশের ছাউনিতে হিজড়াসহ উঠতি বয়সী কিছু সংখ্যক তরুণী অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। রাত গভীর হলে সেদিকে ঘুরতে যাওয়া যুগলদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এদের নিয়ন্ত্রণ করা একটি চক্র। আর এই চক্রটি ঢাবির বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা নিয়ন্ত্রণ করছে।
উদ্যান দায়িত্বরত বেশ কয়েক আনসার সদস্য জানিয়েছেন, উদ্যানে যারা মাদক সেবন করে তাদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের বিরুদ্ধে আমরা তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। বাইক নিয়ে উদ্যানে ঢুকে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করে। আমরা না পারলে থানায় জানাই।
উদ্যানে ডিউটি করা শাহবাগ থানা পুলিশের বেশ কয়েক সদস্য বলছেন, উদ্যানে বহুমুখী অপরাধের অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই আসছে। তবে অনেকেই মামলা করতে চান না। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। ভুক্তভোগীদের যিনি ঘটনায় জড়িতদের সঠিক তথ্য দিতে পারেন, সে ঘটনাটি তাৎক্ষণাৎ উদ্ঘাটন করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু অনেকে কার দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন, এমন সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। তা ছাড়া এখানে প্রতিদিনই কয়েক শ’ মানুষের সমাগম হয়। আইনি তদন্ত ছাড়া কোনো ঘটনা হুট করে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। তবে পুলিশ সন্ধ্যার পর পরই সবাইকে উদ্যান ত্যাগ করতে মাইকিং করে, টহল টিম দর্শনীদের উঠিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী প্রভাব খাটিয়ে উদ্যানে থেকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন নয়। তার পরও যখন আমাদের শিক্ষার্থীরা বাইরে গিয়ে কোনো অপরাধ করে ধরা পড়ে, তখন পুলিশ তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে পুলিশ রিপোর্ট আকারে আমাদের কাছে বিষয়টি পাঠায়। আমাদের শৃঙ্খলা বোর্ড সেই আলোকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। অপরাধ কর্মকান্ডের দায়ে অতীতে অনেক শিক্ষার্থীকে সাময়িক কিংবা ৫/৬ মাসের জন্যও বহিষ্কার করা হয়েছে।


নিউজটি শেয়ার করুন


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
https://slotbet.online/