হালিম মোহাম্মদ
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ
(Google News) ফিডটি
ব্যস্ততম ও ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর যত্রতত্র ব্যাঙ্গের ছাতার ন্যায় গড়ে উঠেছে রেস্তোরা বা খাবার হোটেল। এর বেশির ভাগই রাজধানীন আবাসিক এলাকায় রয়েছে। এছাড়াও সুউচ্চ অট্রালিকার ছাদে বা রুফটপেও গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন রেস্তোরা এবং পার্টি সেন্টার। রুফটপে হোটেল বা রেস্তোরা দেখা গেছে পুরনো ঢাকায় বেশী। এসকল রেস্তোরার সিটি কর্পোরেশন এবং রাজউকের কোনো অনুমোদন নেই। এসকল রেস্তোরায় বেশির ভাগে রান্না চলে সিলিন্ডারের গ্যাসে। যা পুরো বিষয়টি মারাত্মক ঝুঁকি পূর্ণ। রেস্তোরা তো নয়, যেন মরনফাঁদ। রাজধানীর বেইলী রোডসহ রাজধানী বেশকিছু এলাকার রেস্তোরায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। সম্প্রতি রুফটপের রেস্তোরাগুলো বন্ধ করার উদ্যেগ নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ধানমন্ডি, বনানী, উত্তরা, খিলগাঁও, মিরপুরসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ রেস্টুরেন্ট অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। তবে বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য মতে, রাজধানীসহ সারাদেশে আট লাখ রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তার মধ্যে বৈধ ১২৮টি। বাকী সব রেস্তোরা অবৈধ। ২০২১ সালে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাত নিয়ে একটি জরিপ অনুযায়ী দেশের হোটেল ও রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি। গত চার বছরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির তথ্যমতে, ঢাকায় লক্ষাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১২৮টি রেস্টুরেন্টের অনুমোদন আছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি মেগা সিটির সব বিষয়েই মেগা ব্যবস্থাপনা থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় কারও ইচ্ছে হলেই যে কোনো ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট খুলে বসছেন। যেগুলোর অনুমোদন নেই, এগুলো তো ঝুঁকিপূর্ণই। কিন্তু অনুমোদিত রেস্টুরেন্টগুলো তদারকির অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, সিলিন্ডার, গ্যাস লাইনের পাইপ, বিদ্যুতের তার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ওয়্যারিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড় যাচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটলে যে মানুষ তাড়াতাড়ি প্রস্থান করবে, সেই ব্যবস্থাও নেই। বহির্গমন সিঁড়িগুলো মালামাল দিয়ে পূর্ণ করে রাখা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও রাজউকের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। রেস্টুরেন্টের জন্য যখন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়, তখন ওই ভবনের নকশাসহ আনুষঙ্গিক বিষয় খতিয়ে দেখলে এ সমস্যা সৃষ্টি হতো না। এই দুটি সংস্থাসহ আন্তঃ সংস্থার সমন্বয় থাকলে রেস্টুরেন্টসহ অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, আমরা একটি সার্ভে করেছি। সেখানে ডিএসসিসি এলাকায় ৪৫টি ভবনের ছাদে রুফটপ রেস্টুরেন্ট পেয়েছি, যা ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। তাই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেছি। আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক যেসব ভবনে রেস্টুরেন্ট করা হচ্ছে, সেখানেও নিরাপত্তার বালাই নেই। প্রতিদিন বুফেসহ নানা আয়োজন চলে ভবনগুলোয়। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বড় আয়োজনও হচ্ছে এসব রেস্টুরেন্টে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য রেস্টুরেন্টগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি। তবে এখন রাজস্ব কালেকশনের মৌসুম। এ সময় রেস্টুরেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিলে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হবে। আগামী জুলাই মাসে যখন ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করতে আসবে, তখন সব বিষয় চেক করা হবে। তা ছাড়া আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান আছে।
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল হক বলেন, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরিচালিত রেস্টুরেন্টে অগ্নিকা-সহ যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো পরিদর্শন করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই লক্ষ্যে সব সংস্থা একযোগে কাজ করবে। নকশাবহির্ভূত ভবনগুলোর বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডসহ ঢাকার অন্যান্য স্থানের যত নকশাবহির্ভূত ও অননুমোদিত রেস্টুরেন্ট এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে রাজউক। একটি বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার জন্য ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে সব সংস্থাকে নিয়ে কাজ করব। ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজও অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি রেস্টুরেন্টে আগুনের পর রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের আলোচিত গাউছিয়া টুইন পিক ভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় বহু রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরই সেই অভিযান থেমে যায়।
ঝুঁকি বিবেচনায় ভবনের ছাদে থাকা সব রুফটপ রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স সম্প্রতি বাতিল করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করছেন। তাছাড়া অন্য কোনো সরকারি সংস্থার তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সময়মতো উদ্যোগ না নিলে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনের মতো আরও ট্র্যাজেডির অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর পার্ক ও খেলার মাঠসহ ঢাকায় বিনোদনের জায়গার সংকটের সুযোগে চাকচিক্য তৈরি করে রেস্টুরেন্টগুলো বিনোদনের জায়গা দখল করে নিয়েছে। অনুমোদনহীন বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে অসংখ্য গ্যাস সিলিন্ডার।
সূত্র জানায়, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসব রেস্টুরেন্টে চলে রান্নাবান্না। বাড়তি মানুষের চাপ সামাল দেওয়ার মতো কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। বিকেল হলেই ভবনগুলোর সামনের সিঁড়ি ও লিফট মানুষে পূর্ণ থাকে। ধানমন্ডির পুরো এলাকাতেই রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি। এমন কোনো এলাকা পাওয়া যাবে না যেখানে রেস্টুরেন্ট নেই। আবাসিক ভবনগুলোর রেস্টুরেন্ট সবচেয়ে ভয়ংকর। অনেক রেস্টুরেন্ট আবার কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লিফটে ওঠার জন্যও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন। ওই ভবনে ছিল বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ। রাতের খাবার খেতে এসেছিলেন অনেকে। এরপর ভয়াবহ অগ্নিকা-ে প্রাণ গেল ৪৬ জনের। গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ভয়ানক ওই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। কিন্তু তারপরও কি থেমে আছে বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট?
পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৪ শতাংশ রেস্টুরেন্ট রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। আর বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ অবস্থা থাকলে যেকোনো দিনই ঘটতে পারে আরেকটা ‘বেইলি রোড ট্র্যাজেডি।
ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের ১০ নম্বর সড়কের বহুতল ভবন ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার। অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য বানানো হয় ১৩-তলার এই ভবন। কিন্তু ভবনের বেজমেন্টসহ ১৫-তলা জুড়ে রেস্টুরেন্টে ঠাসা। অনেক ফ্লোরে একাধিক রেস্টুরেন্টও রয়েছে। এগুলোতে বুফেসহ নানা ধরনের অভিজাত খাবারের আয়োজন করা হয়। আর ওইসব খাবার রান্না করতে প্রয়োজন হয় উচ্চ তাপমাত্রা। এই উচ্চ তাপ ও চাপে রান্না করতে ব্যবহার করা হচ্ছে সিলিন্ডার গ্যাসসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি।
খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রেস্টুরেন্ট করার জন্য এখন আর অনুমতি লাগে না। একটি ফ্লোর নিয়ে কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে এলেই রেস্টুরেন্ট হয়ে যায়। আগে সন্ধ্যার পর তালতলায় ভিড় হতো। এখন সেই রেস্টুরেন্টের ভিড় অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
উত্তরা এলাকার বাসিন্দা কামরুন্নাহার বলেন, ঢাকায় বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। বাচ্চারা বের হতে চায়। তাদের নিয়ে তো কোথায় না কোথাও যেত হয়। আমরা আর কই যাব? বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টে যেতে হয়।
এবিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, অনুমোদনের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলে উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। এই প্রক্রিয়া সহজ হলে ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হতো। এরপরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় আসছেন, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
https://slotbet.online/